সেদিন পাতাদের বুক চিরে এবং অন্যান্য কবিতা
কবিতা | ৬ মার্চ ২০২৩
১.
সেদিন পাতাদের বুক চিরে
গহিন অরণ্যে নেমে এসেছিল ছোপ ছোপ অন্ধকার
কী যেন একটা দুরুদুরু হাহাকার ছুটে এলো
আমাদের কাশবনজুড়ে তবু
বিকেলের স্মিত উল্লাস—
বসে থাকার চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকা উত্তম
এবং দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে বসে থাকা অধিক উত্তম
তাই আমি কুঁজো হয়ে
সন্ধ্যার নিকটবর্তী জানলায় চেয়ে থাকি
জীবনের যত বাঁক
সগোত্রীয় জঞ্জাল
এলোমেলো কথার ফাঁকে
যত অভিমান জমে থাকে
ধীর, আরও ধীরলয়ে বয়ে যায়
স্বগৃহের পাশেই বেড়ে ওঠে
বেদনার একটা নীল বৃক্ষ।
২.
আজ—
মস্তিস্কের ভেতর শুধু শব্দের সাইক্লোন
কুঁড়ে ভাবনার গোলযোগে পৃথিবী যেখানে খণ্ডিত
সেখানে আমি এক নির্বল পথিক
সারাটা দুপুর
দোতলা বাসের জানলায় কী যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ়
মানুষের হেঁটে চলায় কী যেন অদ্ভুত গ্লানি
শহরজুড়ে বিলবোর্ড
কোথাও নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তিতে ছেয়ে গেছে দেয়ালে দেয়াল।
৩.
মানুষের পাশ ঘেঁষে যেওনা ওদিকে
মানুষের মন নির্মম, সর্পিল
স্বপ্নমুখর ক্লান্ত বাজিগর
শীতের দিন ছায়া হয়ে যায়
কুয়াশায় নিমগ্ন দুপুর বুঁদ হয়ে থাকে
তবু তুমি যেওনা কোথাও
তোমার দীর্ঘ চুলের অরণ্যে কারা যেন পথ ভুলে যায়—
কারা যেন তোমার পাশাপাশি বসে থাকতে চায়
তবু তুমি ভুলে যেওনা
আমাদের সকল অঙ্গিকার
ফেব্রুয়ারিজুড়ে এত এত দিবসের কাল
নোনাধরা জীবনের সম্মুখেই
সুদূরের হুল্লোড়,
যেন জীবন বলতেই শুধু কৌতূহল।
৪.
শুধু একদিন—
নিভৃত জীবনের উপকূলে দাঁড়াতে দাও
সন্ধ্যার সমস্ত গেরুয়া বিষণ্ণতা
মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে
স্বগত বেদনার জানলায়
তবু ফিরে আসে যেকোনো গিরিমল্লিকা
ফোটে অস্তগামী সূর্যের বিপরীতে
আমি ভালো থাকতে চাই—কিন্তু
দীর্ঘ শীতঘুম
থির অবসন্নতা
কেমন করে জড়িয়ে রাখে
পথে পথে দুর্ভোগ
জীবনের সকল উপমা’ও আজ মলিন।
চলো—
ভালো লাগে না এ শহর
ভালো লাগে না মুখোমুখি কৌতুহল, নিশ্চুপ ছল
মানুষের অবদমন মনের ভেতর শুধু অন্তর্লীন রুগ্নতা
কীযে ধোঁয়া-ধোঁয়া গুমোট হাওয়া বইছে...
৫.
আমার হৃদয়ে বেড়ে উঠছে গোপন যত প্রেম
সন্ধ্যা হলে একটা অতিকায় নিঃসঙ্গ পাথর চেপে বসে বুকে—
বেদনারা ডানা ঝাপটাতে থাকে অধীর অপেক্ষায়
কেননা—
যাবতীয় মুখরতা কোথায় যেন ফুরিয়ে গেছে
আমি ছুটে চলি ছায়াহীন আলোর কাছে
রাতের পেলবতা যেখানে নিশ্চুপ।
আরও পড়ুন
এক অজানা অভিমুখে
কবিতা | ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩এ কেমন—
পাথরের গায়ে লেখা কবিতা
সমস্ত জ্যামিতিক পথগুলো
বিধ্বংসী জীবনের পাশে ধীর পায়ে বসে আছে
তথাগতি বৃষ্টি আর এলো না
সকল সুখকর স্মৃতি মুছে গেল
একটা ছাইরঙা প্রচ্ছদে জমে থাকা ধুলো
উড়ে গেল এভাবে
আমার ঠোঁটের চারপাশে ভীষণ তিয়াসা
আজ এই গুমোট রাতের ভেতর
চুপসে যায় আরও গভীর নীরবতা—
কারা যেন বলে
জীবন যেভাবে চলিয়া যায়, তাহাই শ্রী শ্রীমতী
কিন্তু সকলের লালসা কেবল একজন-কে ঘিরে
যার চোখে কোনো ভয় নেই
যার চোখে শুধু জীবনের সরলতা।
আমি আসি এবার,
বিদায় বন্ধু, বিদায়—
আমাদের দেখা হবে কবিতার ভুবনে
কালো পোশাক পরে আমি তোমার সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলব
এই সেই মানুষ—
যে আমার বেঁচে থাকার পাশে খুব করুণার চোখে তাকিয়ে ছিল।
*
এক অজানা অভিমুখে
ঘুম ভেঙে যায়
চতুর্পাশে শূন্যতা
কেবল জীবনের জটিল সমীকরণ
আমার ঘুম আসে না
সারাদিন ভাবি
সারারাত মস্তিষ্কের যন্ত্রণা
আমাকে বিরহী নদীর পাড়ে ফেলে এসো
মানুষের পাশে থেকেও আমি খুব একা
এই দুর্দর্শ সময়ের কোল-ঘেঁষে বেঁচে থাকা অন্যায়।
একটা বিন্দুর কাছে ক্রমশ আরেকটা বিন্দু এবং অন্যান্য কবিতা
কবিতা | ৩১ আগস্ট ২০২৩মা—
তোমার কবরের পাশে
শত-শত নয়নতারা ফুটে আছে
খামোশ অন্ধকারে চুপসে থাকা সাদা মেঘ
আমার কান্না
পাতা ঝরে যায়
ফুল ফুটে যায়
আর আমি প্রতিদিন একা হয়ে যাই—মা
তুমি ছাড়া কোনো বন্ধু নেই
পথে-পথে, পাহাড়ি গিরিখাতে আমি একা একা হেঁটে আসি
বাঁশঝাড়ের পাতা দোলে
মনে পড়ে তোমার কথা
নানুবাড়ির শৈশব
বড় খালা,
মেজো খালাদের বাড়িজুড়ে তোমার কৈশোর
সমস্ত এফোঁড়-ওফোঁড় স্মৃতিকথার দিন
আমার মনে আছে
তোমার আঙুল ছুঁয়ে সেইসব ঘুমন্ত রাতেরা
ভোরের আকাশে ঘোমটা-পরা হাওয়ারা
কেমন করে এসেছিল—
একটা দুপুর ক্ষয় হয়ে যেতে যেতে
আমার আরও মনে পড়ে
তুমি শেষদিন বলেছিলে
‘ভালো কইরা থাইকো বাবা’
পৃথিবীতে মানুষ একা আসে
একা হয়েই ফিরে যায়
আমি তোমাকে ভুলে থাকতে চাই
তোমার স্মৃতিরা আমাকে ঘুমোতে দেয় না
আমার পাঁজর ফেঁপে ক্রমাগত থির বিষন্নতা...
*
একটা জীবনের কাছে
আরেকটা জীবন
দীর্ণ পায়চারির শব্দ
ক্রমশ এগিয়ে আসে
বহুরন্ধ্র ঘেঁষে ছেঁড়া ছেঁড়া আলো
ঘনীভূত বেদনার নীলাকাশ
জানো—
‘ভালো থেকো’ বলে যাওয়া মানুষ
কোনোদিন ফিরে আসে না
থমকে থাকে সেদিনের সমস্ত আকাশ
আমি ফিরে আসব—
একটা বিন্দুর কাছে ক্রমশ আরেকটা বিন্দু
একটা পাতার পিঠে আরেকটা সবুজ
আমার চোখের নিচে কালো-কালো নির্ঘুম রাত।
*
আজ আকাশে নীল নেই
পাতাদের হাওয়া নেই কোথাও
বৃষ্টির কোনো শব্দ নেই
তাই বলে থমকে নেই কিছু
আমাকে ভালোবাসা মানুষেরা দূরে সরে যায়
একদিন নীরবে চলে যাব
কতদিন ভাবি
কতদিন পেয়ারা বাগান ফেলে চলে যাই
কিন্তু ফিরে আসতে হয়
বাপ-দাদার ভিটেমাটি
শৈশব-কৈশোরের এইসব স্মৃতিছায়া
আমাকে বারণ করে রাখে
পুরোনো ভয় নতুন করে গজিয়ে ওঠে
জানো!
আমার আর পৃথিবীর কোথাও ভালো লাগে না।
খড়কুটো জীবনের চেয়ে সবুজ অরণ্য
কবিতা | ৩১ আগস্ট ২০২৩কথার মাঝে কথা ফুরিয়ে এলো
অথচ কত-কত কথা ছিল
প্রত্যুত্তরের পাশে একটা গোমড়া মুখ
পথের বাঁকে হঠাৎ নিরুদ্দেশ মেঘ
এইসব অনেকদিন আগেকার ধূর্ততা
তারপর এভাবেই ভেবেছি
খড়কুটো জীবনের চেয়ে সবুজ অরণ্য
পথের পাশে অদ্ভুত একটা গাছ
আমার ভাবনাদের বনজুড়ে ভীষণ কুয়াশারেখা সময়।
*
কিচ্ছু বলো না তুমি—
চুপিচুপি রাত্রির গোপনীয়তা গাঢ় হয়
আমার ভেতর প্রেম জেগে ওঠে
যদি রাত্রিকে ফালি ফালি করে কাটা যায়
পৃথিবীর সকল স্বপ্ন মিথ্যে হয়ে যাবে
তোমার আঁচলজুড়ে একটা অনাগত মায়ের ঘ্রাণ—
আমার খুব ইচ্ছে জাগে
স্বপ্নের আদলে গড়ে উঠবে দূরের দিগন্ত
*
এইযে এই নীল কান্নার পাশে
আমার এমন উদাসীন রাত
কেউ বোঝেনি
কীভাবে, কেমন করে আলগোছে
রাতের পায়রাগুলো নিস্তব্ধ কুয়াশায় ছেয়ে যায়
মনে হয়—সব কথা
সকল অভিমান আজ আকাশের নীল
কেবলই নীলে-নীলে নীলের পাশে
অদ্ভুত, সব অদ্ভুত কান্নার সমাগম।
*
আমার হৃদয়ে বেড়ে উঠছে গোপন যত প্রেম
সন্ধ্যা হলে একটা অতিকায় নিঃসঙ্গ পাথর চেপে বসে বুকে—
বেদনারা ডানা ঝাপটাতে থাকে অধীর অপেক্ষায়
কেননা—যাবতীয় মুখরতা কোথায় যেন ফুরিয়ে গেছে
আমি ছুটে চলি ছায়াহীন আলোর কাছে
রাতের পেলবতা যেখানে নিশ্চুপ।