সমুদ্দুরের বালিয়াড়ি ঝাউবনে
ভ্রমণকাহিনী | ২ ডিসেম্বর ২০২২
সারাদিনের দীর্ঘ সড়ক এবং সমুদ্র ভ্রমণ শেষে পৃথিবীর সমস্ত গ্লানি যেন আমাদের চাদরে মুড়িয়ে ধরেছে। একরকম ইচ্ছাবিরুদ্ধ হয়েই এখানে আসতে হয়েছে আমার— যদিও বিকেলের বিস্তীর্ণ জলাশয়ের দিগন্তে সূর্যাস্ত দেখে মনে হচ্ছিল আমার মন শুধু শুধুই অভিমানী হয়ে ওঠে কিম্বা যখন আমাদের শিপ বহু চেষ্টা তদবির করার পর একটি সবুজ রঙের দ্বীপ হাতছানি দিচ্ছিল—তখন মনে হয় আমার শুকনো গলা জলে ভিজে গেল। কী অদ্ভুত সবুজে ছাওয়া এই দ্বীপ! কিছুক্ষণ পর-ই আমাদের নামতে বলা হল সমুদ্র পার থেকে কয়েক গজ দূরে অবস্থিত লাল-বোটে— কারণ, একদম সমুদ্র-ঘেঁষা পারে যাত্রীদের নামিয়ে দেওয়ার শক্তি এই শিপের নেই। আমরা গাদাগাদি করে লাল-বোটে উঠলাম প্রায় শ’খানেক যাত্রী। দিনশেষে ব্যস্ত মানুষের প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা কারো প্রিয়জনের মুখে যেই মৃদু হাসির রেখা ফুটে ওঠে— মনে হয় সমুদ্রের শেষ দিগন্তে সূর্যাস্তের আভা ছড়িয়ে পড়েছে তাদের প্রতীক্ষিত মুখাবয়বে। আমরা এবার লাল-বোট থেকে নেমে পড়লাম যার যার মতো করে। সমুদ্র পার থেকে মূল সড়কে যেতে হলে আরেকটি দীর্ঘ ব্রিজ পার হতে হবে— তারপর যানবাহন পাওয়া যাবে, স্থানীয় এক লোক আমাদের এই তথ্যটুকু জানালেন। ফজল এবং ফাহিমের উপর আমার মনে চেপে রাখা ক্ষোভ তখনো যায় নি— ঢাকা থেকে আমরা চিটাগাং হয়ে কক্সবাজার যাব বলেই বের হয়েছি, এরকম কথাবার্তা হচ্ছিল, চিটাগং সি-বিচে এসেই তাদের মুখ ঘুরে গেল। তিন জনের কাফেলাতে শুধু আমার মতামত নিতান্তই অগ্রহণীয় বিবেচিত হলো বিধায় সন্দ্বীপের পথ ধরতে হলো। সি-বিচ থেকে এবড়োখেবড়ো, ভাঙাচোরা পথ পেরিয়ে, ধুলোয় মাখামাখি—দমবন্ধ অবস্থা সবার, অনেক কষ্টেসৃষ্টে কুমিরাঘাট পৌঁছে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারলাম যেন।
২.
আজিজ ভাইয়ের মেহমান হচ্ছি আমরা— প্রথম এবং দ্বিতীয় বর্ষ আজিজ ভাই আমাদের সহপাঠী ছিলেন দারুল ইন’আমে। পারিবারিক নানাবিধ সমস্যার ফলে সবার আড়াল হয়ে এখন তিনি এই সন্দ্বীপ কালাপানিয়া ইউনিয়নে এক নূরানী মাদ্রাসায় এতিম বাচ্চাদের পড়াচ্ছেন। ফোনে যোগাযোগ করে আমরা সন্দ্বীপে চলে এসেছি—আজিজ ভাই তার পরিচিত এক বাইকার পাঠালেন আমাদের নিয়ে যেতে; প্রায় তিন লক্ষ মানুষ বসবাসের এই দ্বীপে যাতায়াত ব্যবস্থার অন্যতম সম্বল বাইক। তিনজন গাদাগাদি করে উঠলাম—পশ্চিমে হেলে পড়া সূর্য যেন আমাদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছে পরম মমতায়। অনাগত সন্ধ্যার আয়োজন চলছে পুরো দ্বীপে— সৌরবিদ্যুতের দাপটে একে একে, থেকে থেকে সজ্জিত হচ্ছে প্রতিটি ঘর, রাতের দ্বীপ। অভাবনীয় মনোমুগ্ধকর এই দ্বীপ আমার মনে জমাটবদ্ধ সমস্ত ক্ষোভ কেড়ে নিল—ফজল আর ফাহিম’কে মনে মনে ধন্যবাদ জানালাম।
৩.
মাগরিবের আজান হচ্ছে, আমরা নেমে পড়লাম সন্দ্বীপ মহিলা মাদ্রাসার সম্মুখ রাস্তায়। সাদা রঙয়ে রাঙায়িত বিশাল তিনতলা ভবনের সামনে বিশালাকার মাঠ সবুজ ঘাসে বিস্তৃত। মাঠের একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আজিজ ভাইকে কল করলাম। মিনিট দু'একের মধ্যে জীর্ণশীর্ণ পাতলা গড়ন এবং সিংহের কেশরের মতো কাঁধ পর্যন্ত লম্বা কোঁকড়ানো চুল বৈশিষ্ট্যময় একজন যুবক আমাদের সামনে উপস্থিত হল। বিস্ময় বিহ্বলে তার সাথে আলিঙ্গনাবদ্ধ হলাম। বেশ ক’বছর পর এই লোকটির সাথে আমাদের সাক্ষাত। আগের চেয়ে অনেকটাই হ্যাংলা হয়ে গেছে। কাঁধ পর্যন্ত কোঁকড়ানো চুল! চেহারায় আগের মতো সেই লাবণ্যতা নেই। বেচারার উপর দিয়ে অনেক ঝড়ঝাপটে গেছে। পারিবারিক এবং শিক্ষাকেন্দ্রিক কিছু উগ্র সমস্যার কারণে পরিবার এবং শিক্ষাকেন্দ্র থেকে সরে যেতে হয়েছে। ভাগ্য তাকে নিয়ে এসেছে বঙ্গোপসাগরের মাঝে এই লোকারণ্য দ্বীপে কিছু বাচ্চাদের দীনি শিক্ষা দেওয়ার জন্য।
৪.
টিনের চৌচালা মাদ্রাসা। খোপ-খোপ করা চারটি রুম। মাদ্রাসার পাশেই পরিত্যক্ত আধো নির্মিত একটি মসজিদ। অনতিদূরে ছোট্ট একটি দীঘি। চাঁদের জোসনা দীঘির পানিগুলোকে স্পর্শ করেছে। ছোটো ছোটো বাচ্চারা নামাজ শেষ করে 'সুরা ওয়াকেয়া' তেলাওয়াত করছে সমস্বরে। কোলাহলময় ঢাকা নগরী ছেড়ে আমরা উপনীত শত মাইল দূরের একটি দ্বীপে। কখনো তো কল্পনাই করি নি যে এমন কোনো দ্বীপে রাত্রি যাপন করব। আজিজ ভাই আমাদের দীঘির পারে নিয়ে গেলেন। মাগরিব নামাজ পড়ার জন্য অজু করে নিলাম সবাই। ফাহিম নামাজ পড়াল।নামাজ শেষে জমে গেল গল্পের আসর। নানাবিধ বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনা আর হাসিঠাট্টা চলল বেশ, এশা পর্যন্ত। এশার নামাজ পড়তে আজিজ ভাই আমাদের বাজারের মসজিদে নিয়ে গেলেন। আগে দূর থেকে পরোক্ষ করেছি যে চিটাগাংয়ের মানুষ আর্থিকভাবেও স্বচ্ছল;মনের দিক থেকেও দরাজদিলওয়ালা—আজ প্রত্যক্ষ করলাম। সত্যিই তারা কল্পনাতীত অতিথিপরায়ণ। নামাজ শেষে আজিজ ভাই তার পরিচিত ক'জন মুসল্লির সাথে সাক্ষাত করিয়ে দিলেন। তারা আজিজ ভাইকে কর্কশ ভাষায় বলতে লাগলেন। হুজুর! তারা সেই ঢাকা থেকে আসবে, আমাকে আগে জানান নি কেন? আজ রাতে আমার এখানে খাবে ওরা। নাছোড়বান্দা এই লোককে অনেক কষ্টেসৃষ্টে বুঝালাম যে অনেক দূর থেকে এসেছি, বিশ্রাম প্রয়োজন—আমরা এখানে দু'তিনদিন থাকব। আপনার ওখানে যাব ইনশাআল্লাহ। তিনি তারপরও ভারিমুখে আমাদের ছাড়লেন। এইযে ভালোবাসা, মানুষ মানুষের প্রতি। এই ভালোবাসা যদি পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে সিঞ্চিত হতো, একে অপরকে ভ্রাতৃত্বসুলভ আচরণে ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রাখত। সুন্দর এই পৃথিবী আরও সুন্দর হয়ে উঠত।
৫.
পিচঢালা সরুপথের দু'ধারে সারি-সারি সুপারিগাছের সমারোহ। ঝিঁঝির ঝি-ঝি চিৎকারে চারপাশটা অসীম নির্জনতায় ছেয়ে যাচ্ছে। কেমন থমথমে পরিবেশ! থমথমে আকাশ। চাঁদ নেই আকাশে; থেকে থেকে শুকতারা জ্বলজ্বল করছে। মৃদু বাতাসে দেহমন জুড়িয়ে যাচ্ছে। আমার চোখের বিস্ময়বিহ্বলতা এখনো কাটে নি। যেন কোনো কল্পজগতে বিচরণ করছি আমি। একটি দ্বীপ; যার চারপাশে লবণাক্ত পানিতে টইটুম্বুর। অথই সমুদ্রজলে বেষ্টিত চারদিক।
আমরা এসেছি কালাপানিয়া ইউনিয়নে, এখানের লোকসংখ্যা পুরুষ/মহিলা মিলে প্রায় উনিশ হাজারের মতো। সন্দ্বীপ উপজেলার উত্তর-পশ্চিমাংশে কালাপানিয়া ইউনিয়নের অবস্থান। উপজেলা সদর থেকে এ ইউনিয়নের দূরত্ব প্রায় ১৪ কিলোমিটার। ইউনিয়নের উত্তরে সন্তোষপুর ইউনিয়ন ও আমানউল্যা ইউনিয়ন ; পূর্বে গাছুয়া ইউনিয়ন; দক্ষিণে বাউরিয়া ইউনিয়ন, সন্দ্বীপ পৌরসভা ও হরিশপুর ইউনিয়ন এবং পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর অবস্থিত। কালাপানিয়া ইউনিয়ন সন্দ্বীপ উপজেলার আওতাধীন ৬নং ইউনিয়ন পরিষদ। এ ইউনিয়ন জাতীয় সংসদের ২৮০নং নির্বাচনী এলাকা চট্টগ্রাম-৩ এর অংশ। কালাপানিয়া ইউনিয়নের প্রশাসনিক কার্যক্রম সন্দ্বীপ থানার আওতাধীন।
১৯৬২ সালের পূর্বে ৭ টি গ্রাম নিয়ে কালাপানিয়া ইউনিয়ন গঠিত ছিল:
১| কালাপানিয়া
২| বাটাজোড়া
৩| কাজিরখীল
৪| দুবলাপাড়
৫| বাওয়া
৬| সাফিনা নগর
৭| চর রহিম
১৯৬২ সালে দুবলাপাড় গ্রামকে হরিশপুর ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বর্তমানে শুধু 'কালাপানিয়া' গ্রাম নিয়েই কালাপানিয়া ইউনিয়ন গঠিত।
আজিজ ভাই আমাদের আরেকটি দারুণ তথ্য দিলেন—
কালজয়ী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল সন্দ্বীপের ছেলে মুজাফফর আহমদ এর। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সাধারাণ সম্পাদক মুজাফফর আহমেদ ছিলেন সন্দ্বীপের সন্তান। ১৮৮৯ সালে সন্দ্বীপের মুছাপুর গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন তিনি। ভারতের রাজনীতিতে কাকাবাবু নামে পরিচিত এই কৃতী সন্দ্বীপীর সাথে বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী পুরুষ নজরুল ইসলামের ছিল গভীর বন্ধুত্ব।
'বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা' সম্পাদনা করতেন মুজাফফর আহমদ। এই পত্রিকায় কাজ করতে গিয়ে নজরুল ও মুজাফফর আহমদ এর প্রথম পরিচয় ঘটে। ১৯১৮ সালে 'বঙ্গীয় মুসলামান সাহিত্য পত্রিকা'য় প্রকাশের জন্য প্রথম লেখা পাঠান কাজী নজরুল ইসলাম। এর পর থেকে দুজনের মধ্যে পত্র লেখালেখি শুরু হয়। মুজাফফর আহমদ ও কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিলো ১৯২০ সালে। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত 'নবযুগ' পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন যৌথভাবে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও রাজনীতিবিদ কমরেড মুজফ্ফর আহমদের। এটি ১৯২০ সালের ১২ জুলাই সান্ধ্য পত্রিকা হিসেবে প্রকাশিত হওয়া শুরু করে। এসময় মুজাফফর আহমদ দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত হন কবি কাজী নজরুল ইসলাম । মুজাফফর আহমদের সংস্পর্শে থেকে নজরুল শ্রমজীবি মানুষের প্রতি আকৃষ্ট হন। তিনিই মূলত নজরুলকে সাম্যবাদী ও বিপ্লবী রচনা কবিতা লিখতে অনুপ্রানিত করেন।
এর পর নজরুল সম্পাদিত 'ধূমকেতু' ও 'লাঙল' পত্রিকায় একসাথে কাজ করেন মুজাফফর আহমদ। ব্যাক্তি জীবনে তাদের দু'জনের এই বন্ধুত্বের প্রভাব ছিল অনেক বেশি। দেওঘরে গিয়ে নজরুল কপর্দকশূন্য হয়ে পড়লে তাঁকে কলকাতায় ফেরান মুজাফফর আহমদ। কুমিল্লায় বিয়ে করতে গিয়ে প্রতারিত হয়ে রিক্ত শূন্য হয়ে পরা নজরুলকে আবারো কলকাতায় ফেরান মুজাফফর। মুজাফফর আহমদ যখন জেলে তখন তাঁর পরিবারের পাশে দাড়াতে সন্দ্বীপ ছুটে যান কবি কাজী নজরুল ইসলাম। মুজাফফর আহমদ ও নজরুল ইসলাম কলকাতা ৩/৪ সি তালতলা লেন এর একটি বাড়ির নিচ তলায় একই রুমে ভাড়া থাকতেন। সে বাড়িতেই নজরুল তাঁর কালজয়ী 'বিদ্রোহী' কবিতাটি লিখেছিলেন। নজরুলের কালজয়ী কবিতা 'বিদ্রোহী'র প্রথম শ্রোতা ছিলেন কমরেড মুজাফফর আহমদ।
সন্দ্বীপ সম্পর্কে আমার কৌতূহল আরো বেড়ে গেল— আজিজ ভাই ইতিহাস প্রেমী, যেখানেই যান— প্রথমত সেখানকার ইতিহাস জানার চেষ্টা করেন৷ এইসব দারুণ দারুণ ইতিহাস জানানোর পর আজিজ ভাই বললেন— তোমরা তো এমনিতেই ক্লান্ত, কাল সকালে আবার বলব— সন্দ্বীপ হচ্ছে একটা রহস্য, যেই রহস্যের জট আজো কেউ খোলতে পারে নি। আমরা আগামীকাল খোলার চেষ্টা করব—আমরা সবাই আজিজ ভাইয়ের কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠলাম।
অনেকটুকু পথ হাঁটলাম শ্রান্ত শরীর নিয়ে। প্রসন্নময়ী রাতের প্রসন্নতা আমাদের ঘিরে রাখল সার্বক্ষণিক। রাতের খাবার শেষে শ্রান্ত শরীর এলিয়ে দিলাম নরম বিছানায়।
৬.
ফজরের নামাজ পড়ে প্রতিদিনকার মতো ঘুমোতে যাওয়ার রুটিনটা কদিনের জন্য পাল্টাতে হবে। আজিজ ভাই ইতোমধ্যে ছাত্রদের সবক নিয়ে এসেছে। আমরা গ্রামে দেখতে বেরুব। গতকাল আসার পর থেকেই আমার মন আনচান করছিল, কখন বের হব।
আজিজ ভাই, ফজল, ফাহিম আর আমি বের হয়েছি। এমন আশ্চর্য সকাল আগে দেখিনি। হেঁটে যাচ্ছি তো যাচ্ছি—কোথাও কেউ নেই। ফজরের পরপর টুপিওয়ালা মুসল্লিদের হেঁটে যাওয়া দৃশ্যপথ আরও চমৎকার। এক অভূতপূর্ব সকাল নেমেছে কালাপানিয়া ইউনিয়নের পথে পথে—আমরা নীরব পরিব্রাজক। সকাল এত মনোহর রূপে আবর্তিত হয়েছে, তা আর বলতে নেই৷ যেখানেই থাকি না কেন আমি! আমার মনোজগত হতে বহুদূরে তুমি৷
আমরা হাঁটছি, আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে বেশ অবাক হতে হচ্ছে। হিজাব পরা তরুণীরা আমাদের দেখেই মৃদু স্বরে সালাম দিচ্ছে। মুখোশের আড়ালে হয়তো তারা হাসছে, অথবা অতিথিদের স্বাগত জানান দিচ্ছে। এ খুব আশ্চর্যজনক মনে হল—অন্যকোথাও দেখিনি এ নিয়ম। ভালোই লেগেছে সকাল সকাল৷ সুন্দরী রমণীর এই সম্ভাষণ আমাদের প্লুত করেছে৷
গ্রাম-ও যে এত গোছালো হতে পারে, তা এখানে না আসলে বোঝা যেত না। বিশেষ করে রাস্তার দু’পাশে এত ঘন গাছগাছালি, দু-পাশের গাছের ডালপালা একে অপরের শরীর জড়িয়ে আছে, প্রকৃতির মেলবন্ধনে যেন সকালের গায়ে ছড়িয়ে দিয়েছে পৃথিবীর সমস্ত বিশুদ্ধ হাওয়া।
আজিজ ভাইয়ের পরিচিত যাদের সাথেই দেখা হচ্ছে, তারা বেশ কুশলি। আমাদের খোঁজখবর নিচ্ছেন, ঢাকা থেকে এসেছি জেনে মহাখুশি। অন্তত একবেলা হলেও যেন তাদের মেহমান হই, এমন আবদার সকলেই করছেন। কিন্তু, সবার ঘরের মেহমান তো আর হওয়া যায় না৷ আদতে, চট্রগ্রামের মানুষদের আমি ভালোবেসে ফেলেছি। এত আতিথেয়তা আর কোথাও দেখিনি।
ততক্ষণে সূর্যের তেজ ক্ষিপ্র গতিতে বাড়ছে। ভীষণ রোদ আমাদের বিরক্ত করছে খুব। আজিজ ভাইকে বললাম মাদ্রাসার দিকে রওনা হতে—বিকেলে বেরুব আবার, এই রোদে বের হলে আমরা আর আস্ত থাকব না, সিদ্ধ হয়ে যাব।
৭.
সমুদ্দুরের বালিয়াড়ি ঝাউবনে আমরা বেশিদিন থাকিনি তারপর। কোনো এক সকালে রওনা হয়েছি ঢাকার উদ্দেশে।
আরও পড়ুন
যেভাবে কবি হবেন
গল্প | ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪আপনার লেখা আমার খুব ভালো লাগে আতিক ভাই। আমি যে আপনার কত বড় ভক্ত, আমি নিজেও জানি না। আমি খুব কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম। আমার কোন বইটি পড়েছেন? সে আমতা-আমতা করে বলল, এখনো পড়া হয় নাই ভাই। তবে আপনার নাম শুনেছি আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে। শুনেছি আপনি খুব ভালো লেখেন, আপনার ‘মেহেরুন, প্রিয়তম ফুল’ বইটা কোথায় যেন দেখেছিলাম—কিন্তু টাকার অভাবে কিনতে পারি নাই। আপনি হাদিয়া দিলে পড়ে দেখতাম আরকি। আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, আমার লেখা সবার জন্য না। সবাই আমার লেখার ধরণ বুঝতে পারে না, বা সবার জন্য লিখিও না। সে বলল, সমস্যা নাই ভাই, আমি বুঝব, আমার দাদাও লেখালেখি করতো, লেখালেখি আমার রক্তে মিশে আছে। আমি বললাম, আচ্ছা একদিন আমার খানকায় চলে আইসেন। আপনাকে বইটা উপহার দিব।
২.
এক শুক্রবার বিকেলে মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে বেরিয়ে দেখি সেই ছেলেটা—আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কীভাবে এলেন? সে বলল—ভাই, ভক্ত তার পীরের কাছে পৌঁছাতে আর কী লাগে? আমি আপনারে মন থেকে ভালোবাসি। আমার আবেগ আপনার কাছে নিয়ে এসেছে, আমি বললাম খুব ভালো। আমার ছোট্ট একটা রুম তখন, বইয়ে গাদাগাদি, কোনোমতো ছোটো একটা খাট বিছানো। ওকে রুমে নিয়ে গেলাম, সে রুমে ঢুকেই হুলুস্থুল কাণ্ড, ভাই—আপনি আমার গুরু, আমার শিক্ষক আপনি, আমারে আপনি উদ্ধার করেন, আমি আপনার পায়ে ধরি বলেই আমার দু-পা শক্ত করে ধরে ফেলল ও। আমি ভয়ই পেয়ে গেলাম হঠাৎ। আমিও আপনার মতো লেখক হতে চাই গুরু, আমার উপর দয়া করেন। আমারে আপনি লেখক বানায়ে দেন, আমার খুব শখ লেখক হওয়ার। আমি হতচকিত হয়ে পড়লাম, কী অবাক কাণ্ড! আমি ওকে ভালোভাবে বোঝালাম যে, দেখো ভাই, এভাবে হঠাৎ করে লেখক হয়ে ওঠা যায় না। সে বলল, আমি হব ভাই। আমি একটা কবিতার পাণ্ডুলিপি গুছিয়েছি—আপনার দয়া পেলে আগামী বইমেলায় সেটা বই আকারে প্রকাশ করব৷ আমি বললাম, আচ্ছা—তা করা যাবে, কিন্তু তার আগে আমাকে দেখিয়েন পাণ্ডুলিপিটা। সে বলল, গুরুরে না দেখিয়ে মরে গেলেও বই করব না। গুরুর দয়া না নিলে আল্লাহ নারাজ হবে।
আমার বুকশেলফভর্তি বই দেখে ও কয়েকটা বই পড়ার জন্য নিয়ে যেতে চাইল, আমিও অন্য সবার মতো ওকে আমার বাছাই করা বইগুলো থেকে কয়েকটা বইসহ আমার লিখিত চারটা বই দিলাম। দেয়ার সময় বলেছিলাম আমার বইগুলো শুধু উপহার, বাকিগুলো পড়া শেষ হলে যেন অবশ্যই আমাকে ফেরত দিয়ে যায়। যাবার সময় আমার সাথে ফেসবুকেও যুক্ত হয়ে নিল ও।
কিছুদিন পর দেখি আমার থেকে নেয়া সবগুলো বই একসাথে ছবি তুলে পোস্ট করেছে, ক্যাপশনে লিখেছে: শ্রদ্ধেয় গুরু, প্রিয় লেখক আতিক ফারুকের পক্ষ থেকে পাওয়া উপহার। কী আশ্চর্য! আমি খুবই অবাক হলাম—আরে মগা, আমি তো সবগুলো বই তোকে দিইনি, আমি শুধু আমার লিখিত বইগুলো তোকে উপহার দিয়েছিলাম। সেদিনের মতো কিছুই বলিনি আর।
দুয়েকমাস পরই বইমেলার ফলে আমার সম্পাদিত লিটলম্যাগ বেয়ারিঙের কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম সেবার। লেখা সংগ্রহ করা, সম্পাদনা, প্রুফ, এসব নিয়ে একটু দৌঁড়ঝাপ সময় কাটছিল। ফেসবুকে বেয়ারিঙের নতুন প্রচ্ছদ প্রকাশ করার সাথে সাথেই ও আমাকে ম্যাসেজ দিল, বলল, গুরু—আমিও লিখতে চাই বেয়ারিঙে। আমি বললাম এখানে নতুন লেখকদের লেখা খুব কম নেয়া হয়, লেখার মান এখনো আপনার তেমন না। আপনি লিখতে থাকুন, একটা সময়ে আমিই চেয়ে নিব। কিন্তু খুব অনুনয় করার ফলে আমি বললাম, ঠিকাছে মেইলে দিন, কী লিখেছেন দেখি। একি! এতো আমারই লেখা। বুনোফুলের দিন থেকে কাটাছেঁড়া করা লাইন। আমার রাগ, দুঃখ তো হলোই, কিন্তু হাসিও পেল খুব। এবারও কিছু না বলে ওকে পাশ কাটিয়ে গেলাম।
৩.
সামনে বইমেলা। দুয়েক সপ্তাহ বাকি এখনও। হঠাৎ দেখি ও ওর নতুন বইয়ের প্রচ্ছদ ছেড়েছে, ক্যাপশন দিয়েছে—‘গুরু আতিক ফারুক’কে উৎসর্গ করলাম এই বই, অমুক নম্বর স্টলে পাওয়া যাবে, আমিও থাকব অমুক দিন, আমার পাঠকেরা আসেন, দেখা হবে, আমার অটোগ্রাফও পাবেন বই কিনলে’।নিজের প্রতি এত রাগ হলো যে—ভাবলাম ও আমার কাছ থেকেই হয়তো আশকারা পেয়েছে, কাকে এত করে বোঝালাম, শিল্প-সাহিত্যের এত জ্ঞান কাকে দিলাম! খুব মন খারাপ হলো।
৪.
বইমেলা শুরু হলো। ওর বইটাও ছেপে এসেছে। ভাবলাম একটু উলটেপালটে দেখি কী লিখেছে ও—সেই প্রকাশনীতে গিয়ে বইটার খোঁজ করলাম, একি! বই নেই স্টলে, একটু দূরে চোখ পড়তেই দেখি ও আড়াল হয়ে আছে, আমাকে দেখে যেই ছেলের দৌড়ে আসার কথা, সে আমাকে দেখে পালিয়ে বেড়াচ্ছে কেন?
কিছুদিন পর কোনোভাবে বইটা আমার হাতে আসে৷ খুলে দেখি এলাহি কাণ্ড! আমার বড়োদের থেকে শুরু করে অনেক পরিচিত কবিবন্ধুদের একটা করে কবিতা উৎসর্গ করা! চৌত্রিশটা কবিতা চৌত্রিশজন-কে। এবং সবগুলো কবিতাই কারো না কারো কবিতা থেকে কাটাছেঁড়া করা লাইন। মনে মনে বললাম, বা...বা...বা... কেয়া সিন হেঁ!
৫.
শুধু বই প্রকাশই নয়। কিছুদিন পর এক বড়োভাই কল দিয়ে বলল, আতিক! অমুক ছেলেটাকে চেনো? তোমার সাথে খুব ভালো সম্পর্ক আছে বলল। নাম জানতে চেয়ে বিস্মিত হলাম, সেই ছেলেটাই! আমি বড়োভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই কী সমস্যা বলুন!—কী চায় ও? ভাই বলল ও টাকা ধার চাচ্ছে। আমি সোজা কথায় বললাম, কোনোভাবেই ওকে টাকা-পয়সা দিবেন না ভাই! ভাই নরম স্বভাবের মানুষ, না করতে পারেনি, শেষে পাঁচশো টাকা দিল ওকে। আমি আনফ্রেন্ড করে নাম্বারও ব্লক করে দিলাম যেন আমার সাথে আর কোনো যোগাযোগ করতে না পারে। এই ছেলে বিপদজনক আমার জন্য।
কয়েক মাস চলে গেল। একদিন হঠাৎ অচেনা নাম্বার থেকে কল এল—রিসিভ করে শুনি ওর কণ্ঠ, কাঁদছে, জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম—ফেসবুকে কোনো একটা মেয়ের সঙ্গে প্রেম হয়েছিল তার, ফেনীর দাগনভূঞা দেখা করতে গিয়েছিল—কয়েকজন ছেলেপেলে ওকে ধরে মারধর করে টাকাপয়সা যা ছিল সব নিয়ে গিয়েছে, ঢাকায় ফেরারও টাকা নাই, কোনো দোকানের নাম্বার থেকে কল করেছে। কি আর করার! আমি কিছু টাকা পাঠালাম।
পরের বছর বইমেলায়ও দেখা গেল তার আরেকটা বই বেরোল, আমার পরিচিত এক বন্ধু প্রচ্ছদ পাঠাল বইটার। এখন প্রতিবছর মেলায় তার কবিতার বই বের হয়। সে এখন অনেক বড় কবি, যৌথকাব্যগ্রন্থও বের হয় তার অনেক লেখকদের সঙ্গে। নিজের প্রতি ধিক্কার জানাই আমি প্রায়সময়—কী করলাম এতবছর সাহিত্য করে, এতগুলো বই লিখে, একটাও কবিতার বই করতে পারলাম না। হায় আফসোস!
দূর জীবনের এ কেমন পরাভূত হাওয়া
গদ্য | ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪যেকোনো প্রস্থানই অনন্ত বেদনার ছায়া ফেলে চলে যায়। কলকাতা বইমেলার পর্দা নেমে গেল আজ, কী অবাক শীত-শীত আচ্ছন্নতা চারদিকে—কতজন, কত মানুষের সঙ্গে বন্ধুতা হলো। কী হবে? এই হতচ্ছাড়া ছোট্ট পাথরটাকে কতজনই তো ছেড়ে গেছে। একাকি নিছানো অন্ধকারে মুখ থুবড়ে কতদিন কেঁদেছে সে। খুব ক্লিশে যন্ত্রণা। তবু এই চেনা-চেনা মানুষগুলো আমার হৃদয়ে একটা মীনরঙ্গ পাখি হয়ে বহুদিন বেঁচে থাকবে।
মানুষের কাছাকাছি না গেলে কখনোই মানুষকে আবিষ্কার করা যায় না। আমি সবার সঙ্গেই কথা বলি—অনেককিছু শেখা যায়, কৌতূহলী না হলে কখনোই ভিন্নতর সৃষ্টির গতিপথ তৈরি হয় না। আমি কলকাতার প্রায় দু’মাস যাপনের দিনগুলোতে প্রতিদিনই কিছু না কিছু শিখেছি, কখনো পায়ে হেঁটে, কখনো দীঘির পাড়ে পাতানো বেঞ্চে বসে, প্রায় দেখেছি একটা অন্ধ লোকের সঙ্গী একটা নিরীহ কুকুর, যে তাকে পথ দেখায়, বন্ধুর মতোই আগলে রাখে।
We live in a wonderful world that is full of beauty, charm and adventure. There is no end to the adventures we can have if only we seek them with our eyes open.
–Jawaharlal Nehru
আমি এক নতুন পৃথিবী-কে দেখতে চেয়েছি। চোখ-কান খুলে তাকানো নয়, মনের দুয়ার খুলে, শিরধার উঁচু করে তাকাতে চেয়েছি চারপাশে—পাহাড়, সমুদ্র বা আকাশের পাটাতন থেকে খুবলে নিতে চেয়েছি মনের সমস্ত অশুভ দর্পণ।
কী হলো—রাস্তাপারাপারের সময় কার আঙুলের সাথে যেন আমার আঙুল ছুঁয়ে গেল—তার চোখের দিকে চোখ পড়তেই কী অদ্ভুত মায়া খসে পড়ল করুণাময়ী মেট্রো স্টেশনে। আমি সেই দু'খানা আবেগ নিয়ে ফিরে এলাম।
দীপ শেখর চক্রবর্তী, আমার প্রিয় দীপ’দা। মুন্নী সেন, শুভদীপ নায়ক আর শিপ্রা মালাকার, শেষ সময়ের সান্নিধ্য আমাকে এত আনন্দ দিয়েছে আজ। ফেরার পথে শুধু মনে পড়েছে খানিক আগেই তো কিছু একটা ছিল, এখন একেবারেই সুনসান নীরবতা।
তবু যদি—আবারও দেখা হয়ে যায়, কোনোকোনো খেয়ারি সন্ধ্যায়। জীবনের জলপ্রপাত কেবলই নিজেকে জানার। সবকিছু অতিক্রম করে নিজেকে ভালোবাসো, নিজেকে জানো প্রিয়তম বন্ধু, কোনো ভয় নেই, কোনো সঙ্কোচ নেই।
২.
কী হলো—পৃথিবী থমকে দাঁড়িয়েছে না তোমার হস্তরেখায় কে যেন বলেছিল একটা শিশুজন্মের মতো অকথ্য বেদনাবহ সময় তোমারও আসবে। ঠিক তা নয়, হয়তো আমিই আমাকে বলেছিলাম ঘোর স্বপ্নে, এক অজানা বিন্দুবৃত্তের ভেতর। জরাজীর্ণ, লক্ষ্যচ্যুত, অনুতাপ, বেদনা, ক্রমাগত বিচ্ছিন্নতা, বিমর্ষ, কলহ, জঞ্জাল আর এত এত হইহুল্লোড় কখনোই আমি চাইনি।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। কি অপলক দৃষ্টি—আমিই আমাকে দেখতে পাচ্ছি, ঠিক ভেতর-বাইরের অবক্ষিপ্ত নীরবতা যেন। কতদিন নিজের সঙ্গে কথা হয় না। তুমিও দেখো, নিজেকে, ভাবো—কেমন আছো? এদিকটায় খুব শৈত্যপ্রবাহ আজ, তুমি ঘুমিয়ে পড়ো, আয়নার নির্জনতার চেয়ে আর কোনো বিভোর শ্রোতা নেই।
৩.
বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে এলেও মন প’ড়ে থাকে মোহাম্মদপুরের গলি-ঘুপচিতে। ঢাকার তল্লাটে পাথরখচিত রাত ঘিরে চিররহস্যের ঘূর্ণনে সন্ধ্যার উপচে পড়া ভিড় ঠেলে যেন আমি দাঁড়িয়ে আছি ঠিক আসাদগেট মোড়ে। কিন্তু না, আমাকে এক্ষুণি বাসায় যেতে হবে। শান্তিপার্কের ছোট্ট বাসাটা গত দেড়মাস ধরে আমার আশ্রয়, সারাদিন কিছু না হলে লেপটেসেপটে শুয়ে থাকি, জানলার পাশে বসে বই পড়ি, ছোট্ট জানালা খুলে আকাশের দিকে চেয়ে থাকি, কী বিস্ময় লাগে! কী অদ্ভুত এ আকাশ!
কলকাতায় আসার পরদিন থেকে দুর্দান্ত কিছু বই সংগ্রহ করেছি। কলেজস্ট্রিট গেলে খালি হাতে আর ফেরা হয় না। সেই পুরোনো অভ্যেস মস্তিষ্কে ঠেসে গেছে। সেদিন কলকাতা বইমেলায় দীপ’দা, মানে প্রিয় দীপ শেখর চক্রবর্তী’র সঙ্গে এতটা দারুণ সময় কাটিয়েছি। গত দেড় মাসের সবচেয়ে ভালো দিন ছিল আমার জন্যে। তারপর থেকে আজও অব্দি রুম থেকে বেরোয়নি আর, বাইরের এইসব হট্টগোল আমার ভালো লাগে না। যদিও আমাদের কলোনিতে কি যেন অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য আছে—মানুষের নরম ভাষা, হলুদ আলোর করতালি আর একাকি বিষণ্ণ মানুষের নির্জীব কান্না।
দূর জীবনের এ কেমন পরাভূত হাওয়া! বলো।
শিথানে গদ্যের অপূর্ব ব্যঞ্জনা
গদ্য | ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪শতাব্দীর স্মৃতিচিহ্ন কখনো এরকম এক ঘোরলাগা সময়ের সাথে ছায়াচ্ছন্ন সবুজ অথচ বিবর্ণ দেয়ালঘেঁষা কলকাতার মুখর গলিগুলো আমাকে আবিষ্ট করে রেখেছে। সেই কবে এসেছি, এখনো বেরোয়নি সেভাবে। লিটলম্যাগাজিন মেলায় খুব গোছানো আয়োজন দেখে মন ভালো তো হলো কিন্তু লিটলম্যাগ নিয়ে আমাদের বাংলা একাডেমির কঞ্জুসপনা আমাকে প্রতিবারই হতাশ করে।
ব্যক্তিগত স্বর, সংস্কৃতি, কবিতা আর ফেনিল বৈঠক সেরে কতিপয় কবিবন্ধুদের সঙ্গে আজকের মতো আলোচনা শেষ হলো। দেবারতি মিত্রের প্রয়াণ খুব গভীরভাবেই আমাকে আহত করেছে। কিছুদিন আগেই তার লেখার সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল।
২.
শান্তিপার্কের চারতলার ছোট্ট একটা রুমে আমি, আমার মামাতো ভাই গাদাগাদি করে আছি প্রায় মাসখানেক হলো। কয়েকদিন পেরিয়ে যায় আবদ্ধ রুমে, আমাদের রুমের ছোট্ট জানালা থেকেই আকাশের অবাক করা খণ্ডাংশ চোখে পড়ে, পাশের বিল্ডিংয়ের বেলকনি, ছাদে টানানো রশিতে ঝুলে থাকা নানান রঙের পোশাক, ছাদের কার্নিশে থরে থরে সাজিয়ে রাখা বৃক্ষচারার টব, তাহলে আমি বাইরে বেরিয়ে কোথায় যাব যদি জানালা খোললেই এত মুগ্ধতা ঘনিয়ে আসে।
৩.
একদল অসুস্থ শুয়োর ছড়িয়ে আছে আমার চারপাশে। যারা আমার পথ আটকাতে চায়—ওদের জুতোটপেটা করে বিতাড়িত করলাম আজ। ‘ক্ষতিকারক সবকিছুই বিতাড়িত করতে হবে জীবন থেকে’ এক বিদগ্ধ মনীষী একদা বলেছিল আমাকে।
৪.
এ কোন অশালীন শীত নেমে এলো সারা কলকাতায়—আমার হাত-পা জমে যাচ্ছে। হলুদ আলোয় একপাল অনুগামী তরুণদল তাদের বৃত্তের ভেতর হাঁটছে। অথচ আমার শিথানে গদ্যের অপূর্ব ব্যঞ্জনা।