আতিক ফারুক

লেখক

অসময়ের দিনলিপি

অসময়ের দিনলিপি

দিনলিপি | ৪ জুন ২০২৩

২০. ২. ২৩

অন্তর্ঘাতমূলক সিদ্ধান্ত কখনোই চাইনি। তবু আপনা-আপনি জটিল ঘটনাবহুলতা আমাকে আগাছার মতো প্যাঁচিয়ে ধরে। এ যেন বিরক্তিকর উপসর্গ। মন খারাপ হয়েছে, দুঃখও পেয়েছি হয়তো, ভেঙে যাইনি তবু। মানুষ কেন তার দায়বদ্ধতা ভুলে যায়, কেন দূরে সরে যায়! অথচ এমনও হয়—কোনো বন্ধুই হতে পারে, যার সাথে মোড়ের টঙে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা না হলে কেমন পানসে লাগত! দিন বদলে যায়, পৃথিবীর কিছু নিয়ম বড়ো অদ্ভুত এবং রহস্যময়। এখন এই তরুণ বয়সে বন্ধুহীন জীবন আমাকে মোটেও পীড়িত করে না। কেননা, কোনো বন্ধু আমার এই দীর্ঘ পথচলার সঙ্গী ছিল না। সেই অর্থে আমার কোনো বন্ধুই নেই আর। কিন্তু মাঝে-মাঝে বন্ধু’র প্রয়োজন হয়, আমার দুঃসময়েও তাদের পাশে পাইনি। যাদের কখনোই আমাকে সঙ্গ দেবার কথা ছিল না, তারাই আমাকে ছায়ার মতো সঙ্গ দিয়েছে। আমার পিছুপিছু দাঁড়িয়েছে শক্ত মনোবলে। তাদের জন্যই আমি বারবার উঠে দাঁড়াতে পেরেছি বলে মনে হয়।

—খ

গতরাতে আরামসে ঘুমোতে পেরেছি। মশার উৎপাতও বেড়েছে। সেজন্য সারাবছর শীতকালই ভালো লাগে—শীত যাচ্ছে যাচ্ছে, আর মশার দলগুলো কোন ফাঁকে, খানিক অন্ধকার পেলেই জটলার মতো পাক খেতে থাকে, কীযে যন্ত্রণা এদের নিয়ে। আমার মশারি টানাতে ভালো লাগে না, গত চারবছর ধরে মশারি টাঙাইনি। জগতের অন্যসব কাজ করতে পারলেও শুধু এই মশারি টানানো নিয়ে কেন যে অদ্ভুত অলসতা কাজ করে, ভেবে পাই না। শুধু আমার নয়, অধিকাংশ ব্যাচেলারদের ক্ষেত্রও এমনটা হয় বলে আমার ধারণা।

শীতের কিছুটা আমেজ এখনো আছে। অনুষ্ণ বা খানিক নাতিশীতোষ্ণও বলা যায় এ সময়টাকে। আমার আজ ঘুম ভেঙেছে অনেক আগে, শেষ রাতে, রুমের বাইরের অন্য আরেকটা সিলিংফ্যানের ভেতর বাসা বেঁধেছে এক চড়ুই দম্পতি, এমন সময়ে প্রতিদিন তাদের চেঁচামেচিতে আমার ঘুম ভেঙে যায়, তবু আজ একটু আগেই ভাঙল। ফজর পড়ে বাইরে বেরিয়ে দেখি কী মিষ্টি পাখির ডাক, কী মিষ্টি একটা সকাল চেয়ে আছে আমার দিকে। সকালের শিরশিরে স্বাচ্ছন্দ্য হাওয়া! জীবনের প্রতি সকল অভিযোগ মুখ থুবড়ে পড়ে থাকতে চায় সকালের শরীরে।

প্রতিদিনের লক্ষ্য পূরণে কিছুটা বিপত্তি বাধছে—তবু বিপত্তি, সময়ের জঞ্জাল ফেলে আমি আমার লক্ষ্যের দিকেই টুকটুক করে এগিয়ে যাব। শুভ সকাল।

২১. ২. ২৩

শহরের প্রতিটা এপার্টমেন্টের, প্রতিটা ফ্ল্যাটের, প্রতিটা বেলকনিতে কীযে রহস্যময় গল্পের প্লট। যেদিন বিকেলে খুব উদাস মনে দশতলা ছাদে দাঁড়িয়ে পাশের কোনো বিল্ডিঙের বেলকনিতে চেয়ে ছিলাম। কত কত গল্প, কত কত জীবন জানলার গ্রিল ধরে চেয়ে থাকে নির্বল চোখে। সকালের একেকরকম গল্প, দুপুর, বিকেল এবং সন্ধ্যা রাতের আরেক রকম গল্প। মুহূর্তে মুহূর্তে গল্প রচিত হয় পৃথিবীতে, প্রতিটা মানুষের জীবনে।

আজ সারাদিন বাসন্তী হাওয়া—কীযে উচ্ছল পাতা ঝরা দিন।

২২. ২. ২৩

গতকাল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ছিল। কিন্তু একটা কবিতা ছাড়া ভাষা নিয়ে তেমনকিছুই লিখতে পারলাম না, জানি না কেন। তবু কবিতায় যেটুকু বলেছি, সেটাই বা কম কিসে!

আজ বুধবার। প্রতিবার মেলায় যাওয়া হয় তিনদিন বা চারদিন, এবারও তিনদিন গেলাম, আরও একদিন যাব যেদিন আমার বইটা বেরুবে।

২৩. ২. ২৩

ভেবেছিলাম আজই বইটা বেরুবে—কিন্তু নিয়তি আমার সাথে উঁকিঝুঁকি খেলছে। আসবে আসবে করেও আসছে না, আজই শেষ বৃহস্পতিবার মেলার—অথচ ‘কতিপয় বৃহস্পতির দিনলিপি’ আসলো না। অপেক্ষা কী কষ্টের—আল ইনতিযারু আশাদ্দু মিনাল মাও’ত’ তো এমনি এমনিই বলা হয়নি।

খুব ব্যস্ত কেটেছে আজ। গোপন কিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করছি, সব কথা সবখানে বলতে হয় না। অনেকেই আমাকে ব্যক্তিগত, মানে ব্যক্তিগত তথ্য জানার জন্য নানান কিছু জিজ্ঞেস করে। আমি খুবই বিব্রত হই। ব্যক্তিগত তথ্য ব্যক্তিগতই, অন্যকে বলার প্রয়োজন কী! আমি যেহেতু লেখক, আমার সাথে সাক্ষাৎ হলে আমাকে সেই অনুপাতে প্রশ্ন করলেই আমার ভালো লাগে। শিল্প-সাহিত্য এবং সিনেমাই আমার আগ্রহের জায়গা।

২৪. ২. ২৩

শুক্রবারের প্রসন্নতা আমি আমার ভঙ্গিতেই বলেছিলাম আমার ‘বুনোফুলের দিন’ বইয়ে। তা আজ আমাকে আবারও স্বরণ করিয়ে দিল এক বন্ধু তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে। কী সুন্দর ছবি তুলেছে বুনোফুলের। এই প্রাপ্তিগুলো অদ্ভুত আনন্দ দেয় আমাকে—লেখকের আনন্দ আর কীসে!

একজন লেখকের এত শক্তি যে—কোনো কোনো পরিবারের সমস্ত লোকেরা সেই লেখক-কে ভালোবেসে ফেলে, লেখকের প্রসঙ্গ এলে সবাই চৌকস হয়ে ওঠে। এমন এমন মানুষের মনে পৌঁছে যায় একজন লেখক, যা অন্যকেউ, অন্যকোনো শিল্প দ্বারা পৌঁছে যাওয়া সম্ভব নয়। সেজন্য লেখক হয়ে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান মনে করি।

২৫. ২. ২৩

আজ নৈঃশব্দ্য দিবস। কিন্তু নৈঃশব্দ্য হওয়া ততটাই জটিল, যতটা নিজেকে ছাড়িয়ে যাবার প্রবণতা। কতবার চেষ্টা করেছি, তবু কোনোদিন নিঃশব্দ থাকতে পারিনি, কান্নারও তো শব্দ আছে—তাই আজকের দিবস, মানে ‘কোয়ায়েট ডে’ পালন করা হলো না।

সারাদিন শুধু কবিতার লাইন ঘুরপাক খেতে থাকে মস্তিষ্কের ভেতর৷ এ এক অদ্ভুত নেশা—কবিতার নেশায় যাদের একবার পেয়েছে, তারা আর ফিরতে পারে না এখান থেকে। আমারও বোধহয় সেই রোগে পেয়ে বসেছে... বসুক—কবিতার মতো জীবন যেহেতু পেয়েছি, সেহেতু কবিতাজীবন আমার কাছে সবসময় আনন্দের। তবু সব ভালোলাগার পেছনে কী যেন অদৃশ্য যন্ত্রণাও লুকিয়ে থাকে—।

২৬. ২. ২৩

আমাদের দেশে সার্কেলভিত্তিক সাহিত্যের যে রূপায়ন, তা কোনো সুরম্য সাহিত্যের পথ না।

সাহিত্যপাড়ায় সার্কেলভিত্তিক ট্রেন্ড এখন ঈর্ষাকাতরতায় রূপ নিয়েছে। অমুক-তমুক সার্কেলে-সার্কেলে যে দ্বন্দ্ব, যে হিংস্রতম আচরণ—তাতে খুবই অবাক হচ্ছি। যেহেতু আমি কোনো সার্কেলে কখনোই নিজেকে জড়াইনি। যারা কোনো সার্কেলে জড়িয়ে পড়েছে, তারা নিজেদের লোকের বাইরে অন্যকারো বই নিয়ে কথা বলে না, তারা ভাবে অন্যের বই নিয়ে কথা বললে জাত যাবে, তারচে বরং নিজেদের লোক-কে মাথায় তুলে নাচাটাই ভালো বলে মনে করি। গালাগাল, একে অপরকে খারিজ করে দেবার প্রবণতা, অপরের ধরণ-কে অস্বীকার, আরও নানাবিধ জটিলতা দেখা যাচ্ছে চারপাশে—নতুনরা এতে বিভ্রান্ত হবে, ফলত আগামীর সাহিত্যে নানান সমস্যা দেখা দিতে পারে।

২৭. ২. ২৩

গতকাল বইমেলার অজস্র স্মৃতি আজও আমাকে ঘুমের ভেতর জড়িয়ে ধরছে। সারারাত আড্ডার পর সকালে মাত্র আধাঘন্টা ঘুমোতে পেরেছি—শরীর মেজমেজ হয়ে আছে। অবশেষে ‘কতিপয় বৃহস্পতির দিনলিপি’ এসেছে গতকাল। কত আড্ডামুখর সময় কেটেছে। হাছিব সাইফ, সালমান সাদ, মোবারক, সাজিদ, আসাদ—আরও কতজন! বইমেলার মাসজুড়ে কীযে আনন্দ।

আজ আর লিখতে ইচ্ছে করছে না। ঘুমহীনতা আমাকে ক্লান্ত করে ফেলে, তাই সবসময় পর্যাপ্ত ঘুমোই—তা না হলে শরীর খারাপ হতে শুরু করে। আজও তাই হচ্ছে—বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না, অথচ কত কাজ প’ড়ে আছে। আরেকটু ঘুমিয়ে নিই তাহলে—ক্লান্তি মুছে গেলে সবকিছু গুছিয়ে নিব আবার, আমার অগোছালো রুম, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বইপত্র—লাকিব্যাম্বুর পাতায় পাতায় ধুলোর পরত এবং আমার মোহময় ঘুমের বনে একটা দীর্ঘ স্বপ্নের ক্যানভাস৷

২৮. ২. ২৩

আজ রাতের পর যখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মাসব্যাপী বইমেলার পর্দা নেমে যাবে—ঠিক তখনই আমার মনে দোল খেতে থাকবে সারা ফেব্রুয়ারি উদ্যানজুড়ে মানুষের কোলাহল, নতুন বইয়ের ঘ্রাণ, লেখক পাঠকদের পদচারণা এবং ফাগুনের দিনে খোঁপায় বেলিফুল বা জিপসি ফুলের গাজরা গুঁজে নারীদের আগমনী সময়ের কথা। যানজট ঠেলে শাহবাগ টু মোহাম্মদপুরের বাস যাত্রার ক্লান্তি। এই-তো। যদিও বছরের পর বছর, শুধু এ মেলাকেন্দ্রিক বহু স্মৃতির কথা বলা যায়। কিন্তু এ বছর লেখক পরিচয় ছাপিয়ে আরও একটি পরিচয় ঘটেছে আমার। কিন্তু, আমি জঞ্জাল হতে বহুদূর থেকে যেতে চেয়েছি সবসময়। আমার পাঠকেরা আমাকে টেনেটুনে গর্ত থেকে বের করে আনতে চায়। ইহা আনন্দের চেয়ে বিব্রতকরও বটে।

সেদিন বিকেলের কথা কীভাবে ভুলে যাই—আরও একটি বার, ঘুমঘুম অলসতা ফেলে কার ডাকে যেন ছুটে গিয়েছিলাম বইমেলায়। ততক্ষণে সন্ধ্যার উদ্ভাস—অস্তগামী সূর্যের বিপরীতে নেমে এসেছে অন্ধকার। শহরের আলোয় আবারও জেগে ওঠে রাত, তার জ্বলজ্বলে বাল্বের সজ্জায় আরও সুন্দর হয়ে ওঠে শহরের নির্জন পিচঢালা পথগুলো। আমার তরুণ মন নেচে ওঠে—এমন একটা নরম আশ্রয় আছে, যেখানে দাঁড়ালে সবকিছু ধীর হয়ে আসে।

বুকের ভেতর ধক করে শব্দ হচ্ছে আজ। আগামী মেলা পর্যন্ত বেঁচে যদি না থাকি, যদি আমি দূরের দেশে চলে যাই হঠাৎ, বা পৃথিবীর প্রান্ত থেকে উধাও হয়ে যাই! অথচ কত লেখা বাকি, এখনও তিনটা অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি। সেগুলো পাঠকের হাতে কবে তুলে দিতে পারব, সেই চিন্তায় মন উৎকণ্ঠিত হয়ে ওঠে কখনো কখনো।

তেমনকিছুই করা হলো না আজ। কিছু ব্যক্তিগত ব্যস্ততায় আগামী কয়েকদিন খুব তড়িঘড়ি সময় কাটবে। ঘুম এবং ব্যস্ততা অন্যান্য অবসন্ন সময়-কে ভুলিয়ে রাখে।

১. ৪. ২৩

বুদ্ধিভ্রষ্ট চাতুর্যতা হলেও এ এক অপলক সময়ের সংস্করণ। গত একটি মাস কীভাবে গড়িয়ে গড়িয়ে এপ্রিলের প্রভাতে এসে ঠেকে গেল, তাই ভাবছিলাম আজ ফজরের পর বৃষ্টিবহুল শহরের কোনো এক বারান্দায় বসে। বৃষ্টি এলে যে উতল হাওয়ার স্মৃতিগুলো তিরতির করে কাঁপতে থাকে কল্পনাবিলাস মনের ক্যানভাসে—তা সত্যিই, কখনো ভীষণ ভালো লাগার, কখনো ভীষণ মন খারাপের।

বহুদিন পর মনে হলো নিজের মূলধারায় ফিরতে পেরেছি—এইতো লিখছি, যাপনের রূপরেখা কলমের খোঁচায় খোঁচায় আবারও প্রানবন্ত দিনের কথা প্রস্ফুটিত হবে। আমার আবারও ভালো লাগবে, ততটা দুঃখিতও নয়। তবু ব্যস্ত সময়ের গ্লানি নিয়ে একটুও লেখা হয়নি৷ কেমন ফাঁকা ফাঁকা সবকিছু, ফাঁকা ফাঁকা অনাদর।

যেহেতু গত পুরোটা মাস লেখা হয়নি—সেহেতু আক্ষেপ নেই কোনো, আজ হয়তো লিখতে পারছি, কাল হয়তো কিছুই লেখা হবে না। আজ এই অনুনাদিত হাহাকার ঠেলে কোথায় যে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। মানুষের উড়নচণ্ডী, ছলছল বেদনাপুষ্ট মন—বারবার খুব গোপন হয়ে যেতে ইচ্ছে করে।

আজ এপ্রিলের এক তারিখ—গতরাতে একজন আমাকে বোকা বানিয়েছে, গোবেচারার মতো আমিও অনেকটা ভড়কে গিয়েছিলাম—পরে জানতে পারলাম আজ এপ্রিল ফুল, মানে অন্যকে বোকা বানানো দিন।

গত দুদিন রাতে বৃষ্টি হচ্ছে। ফলে ঘুমও ভালো হচ্ছে, পূর্বের রোজার মাসগুলোতে গরমে যা হাপিত্যেশ অবস্থা হয়েছিল, সেই তুলনায় এবারের রোজায় গরমের অস্থিরতা খুবই সামান্য বলে মনে হলো।

আজ শনিবার—গতকাল খুব ঝক্কি ঝামেলার পর আজ একটু অবসর সময় পার হচ্ছে। কোনো কাজ না থাকলেই বরং নিজের সাথে বোঝাপড়া করা যায়, নিজের সাথে কথা বলতে গেলে কত কী মনে পড়ে, মনে হয় নিজেই নিজেকে খুব ভালোবাসি। আমি তোমাকে ভালোবাসি আমার জীবন।

৩. ৪. ২৩

বয়স যত বাড়তে থাকে—পারিপার্শ্বিক উচ্ছলতা ততই নিরানন্দ হয়ে ওঠে... কেমন যেন অদ্ভুত আনন্দগুলো ফুরিয়ে যায়। বছরে বছরে রোজার আবেদন, শৈশবের উৎসবমুখর অনেক মুহূর্তই আজ আর সেভাবে উপভোগ করা যায় না। কৈশোরের যে দুরন্তপনা তা তারুণ্যে এসে লুপ্ত হয়ে যায়, আবার তারুণ্যের যে উচ্ছলতা তা লোপ পেয়ে যায় যখন সাংসারিক চিন্তার ভাঁজ পড়ে কপালে। এভাবেই জীবনের একেক বয়সের একেক পরিক্রমা। একেক মুহুর্তের একেক আবেদন।

আজ বহুদিন পর নদীপাড়ে বসে ছিলাম আমরা। এই রোদের দুপুরে—কীযে ভালোলাগা দিন! খুব রোদ, তবু তেজ নেই—ঝিরিঝিরি হাওয়া বয়েছিল তখন।

রোজায় ধরেছে আজ। ঘুম থেকে উঠেই পেটব্যথা শুরু হয়েছে। কেমন করে যে আমার দিনগুলো পেরিয়ে যাচ্ছে, নিজেই বুঝতে পারছি না, সময়ের সাথে দৌঁড়ে পারা গেলে কবেই আমি সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকতাম।

কোনোকিছুই লেখা হচ্ছে না। লিখতে পারছি না আসলে। চেষ্টাটুকুও হচ্ছে না অবশ্য। সময়ের যা আকাল...

১৫. ৪. ২৩

এত অস্থির লাগছে গত কয়েকদিন। রোজার প্রথম কয়েকদিনের আবহাওয়া সহনীয় ছিল—কিন্তু এখনকার গরমের যা তাপ—সিলিং ফ্যান চলছে ঠিক, কিন্তু বাতাসের কোনো নামগন্ধ নেই, গত সারারাত নির্ঘুম কেটেছে, প্রথমত গরমের হাঁসফাঁস, দ্বিতীয়ত মশার ভনভনানি। তবু মশারি টানানোর মতো দুর্বোধ্য কাজটা আমার দ্বারা হয়ে ওঠে না। এই এখন ঘুম ভাঙল ঘামে ভেজা শরীরে—রোজার শুরুতেই কোনো এক দিনলিপিতে আমি সেসময়ের সুন্দর আবহাওয়া নিয়ে লিখেছিলাম, ভাবতেই পারিনি যে এখন আবার এই অস্বস্তিকর রোদের কথা এভাবে লিখতে হবে।

কোথায় গিয়ে শান্তি পাব বলো—শহরের তীব্রতর রোদে জীবন হয়ে উঠছে আরও ক্লিশে, আরও ঘনায়মান অস্থিরতা।

ভাবতে ভাবতে, কীভাবে কীভাবে রোজার মাস’ও শেষ হয়ে এলো। সময়ের কোনো ধীরতা নেই, কেমন করে ফুরিয়ে যায় একেকটা দিন, চোখের পলক’ও বোকা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

আজ পনেরোই এপ্রিল—আমার কত কত পরিকল্পনা ছিল, সব ভেস্তে গেল। তবু নতুনভাবে, নতুন উদ্যমে দাঁড়াতে পারব বলে নিজের প্রতি বিশ্বাস আছে—সেটুকু ভেবেই শান্ত হই, নিজেকে বোঝাতে পারাটাই কাজের কাজ বলে মনে হয়। জীবনে সবচেয়ে বেশি বোঝাপড়া করতে হয় নিজের সঙ্গে—তারপর অন্যদের আবদার।

কবি-সাহিত্যিকের জীবনে আবার এত ভাবনা কীসের, সে-তো কথা বলবে সময়ের সঙ্গে, কালের সীমারেখা কতদূর! মাঝে-মাঝে ভাবতে হয়, আবার অতশত ভেবেই বা কী লাভ! যা হতে পারে বলে ভাবা হচ্ছে, তার বিপরীত ঘটনার মুখোমুখিও হতে হয়—তাই আমি কোনো কাজ বা বিষয়ের প্রতি ততটা নিশ্চিত নই—কারণ, যেখানে নিশ্চয়তা সেখানেই পরাধীনতা, আর যেখানে অনিশ্চয়তা, সেখানেই স্বাধীন জীবন। আমি স্বাধীন জীবনের দিকেই ছুটে চলি। বন্ধু, তুমি আমার সঙ্গী হবে!

১৭. ৪. ২৩

সময়ের আকাল চলছে এবছর—এই বঙ্গদেশে কখনোই তো আমরা সুশাসন দেখিনি, দস্যুবৃত্তি বিপর্যয়ের ঘানি সাধারণ মানুষের জানমালের উপর দিয়ে হেঁটে যায়। অভিজাততন্ত্রের অপপ্রয়োগ এবং অকৌশলের মহামারি চিত্র বহুবছরের পুরোনো। সবাই রাজা হতে চায়, কেউকেউ রাজার পদ না পেয়েও অনেককিছুই কামিয়ে ফেলে, আর তার নিরন্ন প্রজারা না খেয়ে খেয়ে মরে যেতে থাকে।

কিছুই করে শান্তি পাওয়া যাচ্ছে না—একটা শীতল পুকুরের পাশে মেহগনির ছায়াঘন পাতাদের পাশাপাশি সারাদিন ঘুমিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে—হাওয়াদেরও শক্তি নেই, তাদের শরীর থেকে সমস্ত কোমলতা খসে পড়েছে।

ইদের বেশিদিন বাকি নেই—এবারের ইদ করব ঢাকার বাইরে, ঢাকায় দমবন্ধ লাগছে খুব—কোথায় যাব, তাই ভাবছি। আমাদের পথ হলো নদী আর সমুদ্রের পথ—শুধু সেদিকেই যেতে ইচ্ছে করে।

আজ Everything in the End দেখে শেষ করলাম—তারপর থেকে সমুদ্রের গর্জনই কানে বাজছে, আর পাউলোর একাকিত্বের জীবন, অনেকটা আমারই জীবনের সাদৃশ্য, শুধু সমুদ্রদ্বীপে দীর্ঘ যাপনের অপেক্ষা।

২৬. ৪. ২৩

আমার জানালার বাইরে সারাদিন শিশুদের কোলাহল—পাখিদের কোলাহলজুড়ে আসন্ন দুপুরের অবসাদ, বাড়িতে এলেই সারাদিন আমার চোখে ঘুমঘুম জড়তা নেমে আসে। শহরের চেয়ে গ্রামের যাপনই আমার ভালো লাগে৷ শুধু প্রতিবেশী মানুষের পরচর্চা, বিদ্বেষ, আলাভোলা সাধারণ মানুষও কখনো নিজের অজান্তে অপরের ভীষণ ক্ষতি চায়। অপরের সুখ দেখতে পারে না বলেই গ্রাম আমার কাছে কখনো কখনো ভীষণ ক্ষতিকর।

দুপুর হবারও অনেক আগে পাড়ার শিশুদের কোলাহল থেমে গেলে মাঝদুপুরে পাতাদের ঝরে পড়া খসখস শব্দ, বাঁশঝাড়ের আড়াল হতে বহুদূর দিগন্তের কাছে হেলান দিয়ে বসে থাকি। তুমি তো জানো—আমার যাপন, আমার চিন্তার ভাঁজে ভাঁজে তোমার অনুপ্রবেশের ফলে একটু একটু অগ্রসর হতে শিখেছি আমি।

গত দুদিন বৃষ্টি পড়ার আচ্ছন্নতা, রোদেপুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া টবগুলো নতুন জীবন ফিরে পেয়েছে আজ। আমার জন্য খুবই আনন্দের, আমার হাতের ছোঁয়ায়, যত্নে বেড়ে উঠছে ওরা! হল্লাকরা মানুষদের কৌতূহলী চোখে বিভ্রান্ত জীবনের অনেক প্রশ্ন—কিন্তু তারা শোধরাতে চায় না নিজেকে, শুধু কৌতূহলী হয়।

আবারও, শহুরে জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যেতে হবে আমাকে। কোথায় যে মন স্থির হবে আমার—কখনো ভেঙে পড়ি, কখনো উঠে দাঁড়াই, তবু এই নিঃসংশয়তা, তবু এই সিদ্ধান্তহীন পরিখা অতিক্রম করে যেতে পারি না।

এইসব কী দিনলিপি! এইসব কী ছাইপাঁশ পুরোনো কিছু সংলাপ! আমারই তো কথা, যেভাবে বলে শান্তি পাই, সেভাবেই বলি। তোমরা শুধু একান্ত, নিমগ্নশ্রোতা।

৬. ৫. ২৩

মানুষের ভাবনার বৃত্ত বিশাল। ধরুন একটি নির্জন শহর বা একটি নির্জন গ্রাম—আপনি কোথায় যেতে পছন্দ করবেন! আমি নিশ্চয়ই নির্জন শহরের দিকেই ধাবিত হব—কেননা গেঁয়োমূর্খ মানুষের তৎপরতার সঙ্গে শহুরে মানুষের শ্রেণিগত আচরণে অনেক পার্থক্য। আমি গ্রামের মানুষ হলেও, শহরের ধুলোবালি যান্ত্রিকতা আমাকে পিষ্ট করলেও গ্রাম ছেড়ে শহুরে হয়ে যেতে চাই আবার। যেন আমি নক্ষত্রের দিকে ছুটে চলেছি—শহরই আমার কাছে চির আনন্দের। গ্রামের সেই সুন্দর আবহ আর ভালো লাগে না। মানুষের উদ্ভ্রান্ত কথা আমার শরীরে বিদ্ধ হয়। শহরের সকল মানুষ জীবনমুখী, কর্মব্যস্ত চঞ্চল, তাই ভালো অন্যের দিকে সন্দেহ আর পরচর্চার দৃষ্টির চেয়ে।

বেঁচে থাকার জন্য কী প্রয়োজন একটা মানুষের! আদর্শিক যাপনের যাত্রা শুরু হয় কীভাবে—স্বাধীন জীবনের অধিকতর বিড়ম্বনা উতরিয়ে কীভাবে পৌঁছানো যায় মনোজগতের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থানে! তা আমাকে খুঁজে বের করতে হবে—মনের ভেতর হতাশা আর অপ্রাপ্তি নিয়ে বেঁচে থাকা যায় না। কিছু তো পেতে হয়, অন্তত একটা নরম চোখ, অন্তত একটা শীতল চাহনি বা আমার মন খারাপে খুব নীরবে বসে থাকা কেউ একজন।

আজ কী বার! শনিবারের সন্ধ্যা এখন—অথচ কতকিছু পাল্টে যায় একদিনের পালাবদলে, গত কয়েকটা মাস এত ব্যস্ততায় কেটেছে, কোথাও বেরুতে পারিনি। ভেবেছিলাম ঈদের পরপর বেরুব, মায়ের অসুস্থতার ফলে তা আর হয়ে ওঠেনি। একটা দীর্ঘ ভ্রমণের প্রয়োজন—কিন্তু জীবনের কাঁটাতার এমন—একদিক কেটে বেরুতে চাইলে আরেকদিক শরীরের ভেতর ঢুকে যায়, ক্ষত তৈরি করে। কিন্তু আমি সেই একরোখা রাখালের মতো, যার গরুর পাল থেকে গরু ছুটে গেলে সে বেত্রাঘাত করে সংঘবদ্ধভাবে তাদের নিয়ে যায় নির্দিষ্ট গন্তব্যে।

জীবনের ক্রান্তিকাল চলছে, শুধু জীবন নয়—পরিবার সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত জীবনের হাহাকারের সময় এ। আমার কথা আশ্চর্যজনক মনে হলেও এ কথা চির সত্য যে, আমরা পৃথিবীর বয়োজীর্ণ সময়ে এসে পৌঁছেছি। কোথাও কেউ ভালো নেই।

২১. ৫. ২৩

মা অসুস্থ হবার প্রায় আটমাস হতে চলেছে। প্রথমত ব্রেইন-টিউমার, তারপর ব্রেইন ক্যান্সার! গত কয়েক সপ্তাহ ধরে শরীরের বাঁ পাশ প্যারালাইজড হয়ে গিয়েছে—ডাক্তার বলেছে আর কোনো চিকিৎসা নেই, এভাবেই যতদিন বেঁচে থাকে। বসাতে হলে কয়েকজন ধরে বসাতে হয়, শুধু ঝাপসা চোখে আমাদের দিকে তাকাতে পারে, মৃদুস্বরে কথা বলতে পারে। আর কোনো শক্তি নেই আমাদের মায়ের শরীরে। আমাদের মা আবারও শিশু হয়ে গেল—এমন দিন এসেছে আমাদের জীবনে, আমাদের পরিবারে এমন শোক জেঁকে বসেছে, এ দুঃখের অনুভূতি কাউকে বলা যায় না। একা একা, চুপি চুপি কাঁদতে হয়।

শিল্পসাহিত্য, জীবনের সকল পাঠ মায়ের অসুস্থতার পাশে ঝিম মেরে বসে থাকে, সবকিছু মূল্যহীন হয়ে যায়। তুমি কোনোদিনই বুঝবে না আমাদের মা তোমাকে ঘিরে কত কি ভেবেছিল, তোমার পুরোনো নাকফুল ঘিরে কত কি স্বপ্ন বুনেছিল। হাসপাতালের দিনগুলো কিরকম দুর্দর্শ যাতনার তা যদি জানতে!

আমাদের জীবনের আটটি মাস খুব নিথর হয়ে পড়ে আছে। মায়ের মুখের দিকে তাকালে আমরা অবাক হয়ে যাই—সেদিনের শাড়ি পরা যুবতী আজ এভাবে শয্যাশায়ী, ঘরের সমস্ত কাজ সেরে উঠোন ঝাড়ু দেয়া আমাদের মা আজ এভাবে, ছোটো-ছোটো পলকে চেয়ে থাকে।

এমনও দিন যায়, সারাদিন কোনো কথা বলে না মা, শুধু শুধু জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে।

আমাদের মা হয়তো মারা যাবে—এভাবে হয়তো বলা যায় না, হয়তো আমাদের মা আরও বহুদিন বেঁচে থাকবে আমাদের সাথে। ছোটোবেলা মা-কে বলেছিলাম, মাগো—তোমাকে আমি সমুদ্র দেখাব, পাহাড় দেখাব। বড়ো হয়ে তা আর পারলাম না! এত ব্যস্ত সময় বয়ে গেল তারপর—কে জানে তুমি এত দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়বে!

মাগো—তোমার জন্য চিরতরুণ হয়ে আমি বেঁচে থাকব পৃথিবীতে, নিশ্চয়ই তোমাকে আমি সমুদ্র দেখাব মা।

২৩. ৫. ২৩

গত এক সপ্তাহে দুটো মাদ্রাসার সাহিত্য আসরে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। গত মঙ্গলবার গিয়েছিলাম ভাটারা মাদরাসাতুল ফুনুন আল-ইসলামিয়্যায়। ভরা মজলিশে ছাত্রদের সাথে সাহিত্যের নানান দিক নিয়ে কথা বলেছি। চিন্তাগত মতদ্বৈধতা এবং একপেশে শিক্ষার সংকটময় আবহ প্রায় ছাত্রদের মাঝে দেখতে পেয়েছি। তবে এভাবে ধীরে ধীরে শুধু সাহিত্যই নয়, সামগ্রিক চিন্তার দুয়ার খুলে দিতে হবে তাদের সম্মুখে, তাহলেই নিজেদের মনোবৈকল্য এবং সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরুতে পারবে তারা।

গতকাল গিয়েছিলাম জামিয়া রাহমানিয়া আজিজিয়ায়—ছাত্রকাফেলার নিমন্ত্রণে। তাদের জিজ্ঞাসা, সাহিত্যের প্রতি তাদের অনুরাগ এবং মেধার যে বিকাশ আমি লক্ষ্য করেছি, ফলত তাদের চেষ্টা এবং জানার আগ্রহ-কে আমি সম্মান জানাই। তারা প্রতি সোমবার সাহিত্য আসর করবে বিকেলের অবসর সময়ে। আগ্রহ যেন ফুরিয়ে না যায় প্রিয় বন্ধুগণ। আপনাদের চেষ্টা এবং আমার প্রতি শ্রদ্ধার কথা স্বরণ থাকবে। ভালো থাকুন, অনেক ভালোবাসা জানাই আপনাদের।

২৪. ৫. ২৩

যেকাউকে তার চিন্তাগত সংকটের কথা বলতে গেলে আপনাকে আক্রান্ত হতে হবে তার আচরণে। আমি তেমনই এক বিপাকে পড়ে গিয়েছি গতকালের একটা লেখার কারণে। আমার ভাষ্য ছিল কিছু ছাত্রদের নিয়ে, সেভাবে কোনো ঘরানার লোকদের ছোটো করার ন্যূনতম আগ্রহ নেই, কখনো এসমস্ত বিষয়ে লিখিনি আমি। কিন্তু লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি, তার চেতনা এবং ভাবনা প্রকাশের স্বাধীনতায় আপত্তি তোলার অধিকার যেকারো থাকতে পারে, তাই বলে ব্যক্তি-আক্রমণের যৌক্তিকতা কী আসলে! আমার শিক্ষা কী, কে আমি এবং আমার পরিচয়ই বা কি! সেসমস্ত আলাপ তো অবান্তর, অপ্রয়োজনীয় এবং ছোটো মানসিকতার পরিচয়। আমি সেই সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির কথাই বলেছি সেখানে। কিন্তু কিছু লোক-কে দেখলাম তারা আমাকে নিয়ে নানান আলাপ জুড়ে দিয়েছে।

দেখুন—আমি কোনো ঘরানার লেখকই না। আমার একমাত্র পরিচয় আমি লেখক। আমার পড়াশোনা বা ব্যক্তিপরিচয়ের প্রশ্ন এখানে অযৌক্তিক।

তর্ক-বিতর্কের পাঠ বা যুক্তিতর্ক, যেকোনো উঁচু গলার কথা আমি পছন্দ করি না। পৃথিবীর সকল মানুষের কাছে গ্রহণীয় হয়ে ওঠা যায় না, কেউ হতে পারেনি। আমিও নিশ্চয়ই কোনো ঘরানার মানুষের কাছে গ্রহণীয় বা বর্জনীয় হওয়ার ক্ষেত্রে ভাবি না।

আমাকে ব্যক্তি-আক্রমণ করুন। আমাকে ছোটো করুন, তবে আমার আলাপ বুঝে তার মর্মোদ্ভেদ করে তারপর।

আমার প্রতি কার কী ধারণা তা বিবেচনা করার সময় বা আগ্রহ কোনোটাই আমার নেই। তাই আপনারা আমার পেছনে সময় নষ্ট না করে নিজেকে তৈরি করুন। ধন্যবাদ।

এখানে এসেও হয়তো কেউকেউ আপত্তি তোলতে পারে আমাকে বা আমার লেখালেখি নিয়ে—তাদের স্বাগতম।

২৬. ৫. ২৩

আজ বহুদিন পর বাতিঘরে পা রাখলাম। দিনগুলো এমন গ্রোগাসে গিলে খাচ্ছে আমার হাপুসহুপুস ব্যস্ত সময়—নিজেকে নিয়ে একান্তে একটুখানি ভাববার সময়টুকুও নেই। তাই আজ শুক্রবারের অবসন্ন বিকেলে বাড়ি থেকে বেরিয়েছি একা, এবং একা একাই বাতিঘরে কয়েক চক্কর দিয়ে দুয়েকটা বই কিনব কিনব করেও খালি হাতেই বেরিয়ে পড়লাম।

না, আজ কোনো বই কেনা হলো না। বই কেনার আগ্রহ ফুরিয়ে যাচ্ছে কি না বুঝতে পারছি না, তবু মনের যে উদাস বেদনা তা থেকে বেরুতে পারার একমাত্র অবলম্বন আবার এই বই-ই।

আমাকে একঘন্টা বসিয়ে রেখে এসেছে ও, হাসিব সাইফ, আমার একমাত্র বন্ধু। নিয়মিত যোগাযোগ না হলেও ওর সাথে আমার মনো-সংযোগ খুব চমৎকার। বহুদিন পর সেই চিরচেনা আড্ডামুখর রাতের মতো আমরা আজও আজিজ সুপার মার্কেটের ‘বুকক্যাফে’-তে বসেছি।

কত কথা আমাদের—কী বিমর্ষ মন এবং তার কী অদ্ভুত তাড়না।

কিন্তু, যেভাবে আমি ভেবে রেখেছিলাম—যেভাবে দিনলিপির খসড়া সাজিয়েছিলাম, তা বাস্তবিকভাবে ঘটল না। শহরের যান্ত্রিক যানজটের ফলে হাসিব আসতে পারলো না, তাই আমি একা একা ধুলোঝড় উপেক্ষা করে আমার গন্তব্যে চলে আসলাম।

হয়তো আজ রাতে খুব বৃষ্টি হবে। আকাশে খুব মেঘগর্জন।

২৮. ৫. ২৩

লেখকের সবচেয়ে কোমল এবং তীক্ষ্ণ অনুভূতিপ্রবণ জায়গাই হলো লেখালেখি। লেখক কখন আনন্দ পান এবং কখন ক্লেদাক্ত হৃদয়ে বসে থাকেন, তা কেবল লেখকেরই জানার কথা। যখন কেউ এসে লেখক-কে শুধু তার লেখক হয়ে ওঠার ফলে, তার চিন্তাদর্শনের ফলে তাকে অপদস্থ করতে চায়, লেখক তখন দুঃখ পান। পৃথিবীর সমস্ত লেখক সংবেদনশীল—আর সংবেদনশীল মানুষের জীবনে সুখের চেয়ে দুঃখের গল্পই বিস্তর।ধ্যানমগ্নতা ছাড়া লেখক তার লেখায় শিল্পরূপ ফোটাতে পারবে না কখনো—তাই লেখকের ভাবনাজুড়ে, চিন্তাজুড়ে সারাক্ষণ নতুন সৃষ্টির জল্পনা।

কখনোই কোনো মোহ, সুখ্যাতি লেখক-কে প্রলোভিত করতে পারবে না। লেখক শুধু তার শিল্পের আবরণে সুপ্ত নদীর স্রোত-কে জাগিয়ে তোলতে জানে, মানুষের হৃদয়ে ভালোবাসার কথা পৌঁছে দিতে জানে, আরও জানে মানুষকে কষ্ট দেয়া শিল্পীর কাজ নয়—শিল্পীর কাজ কেবল প্রতিবেশের সকল বিবাদ উপেক্ষা করে নিজের ধ্যানমগ্নতায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকা।

আমার কখনো মনে হয়নি আমার প্রতি মানুষের কী ভাবনা—মানুষ আমাকে নিয়ে কী ভাবছে, সবসময় মনে হয়েছে আমার লেখকজীবনজুড়ে সকল ঘাত-প্রতিঘাতের সময়ে আমি নিজেকে শান্ত রাখতে পেরেছি, চুপিচুপি ভেবেছি কীভাবে এই দুঃসময় থেকে বেরিয়ে আসতে পারব। তাই হয়েছে, নির্দিষ্ট সময়ের পর আমি বেরুতে পেরেছি, আবারও দুঃখ পেয়েছি, আঘাত পেয়েছি, আবারও সুদিন এসেছে। কিন্তু তৎসত্ত্বেও একটু লিখতে পারা সক্ষমতা আমাকে নতুনভাবে ভাবতে শিখিয়েছে—যখনই বড়ো রকমের কোনো দুর্ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি, তখনই কলম হাতে নিয়ে লিখতে বসেছি, যখন কোনো সুদিনের হাওয়া বয়ে গিয়েছে, তখনও কিছু না কিছু লিখতে পেরেছি—এই লিখতে পারার জীবন নিয়ে আমি সবসময় আনন্দিত—আল্লাহপাক আমাকে এই মেধাটুকু দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, সেজন্য তার প্রতি আমার হাজার শুকরিয়া।

এইযে একা একা বসে আছি—আমি লিখতে পারি বলেই একাকিত্বের সময়টুকুতে, মনের অবসন্নতা, শূন্যতা, এবং খুব বিষাদের অনুভূতিটুকু প্রকাশ করতে জানি—লেখক না হলে এই অদ্ভুত অনুভূতিগুলো কীভাবে পার পেয়ে যেতাম—ভাবতেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। ভয় হয়, খুব ভয়। সেজন্যই পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী মানুষ বলতে আমি লেখকদের জানি। যাদের কলমের খোঁচায় সবকিছু এফোঁড়ওফোঁড় করে দেবার সক্ষমতা আছে।

হয়তো কখনো, কোনো কথার ফলে—ভুল শব্দের প্রয়োগ বা অসচেতন বাক্যের ফলে লেখকের কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে যায় বা তাকে কলঙ্কিত হতে হয়—কিন্তু পৃথিবীর সকল ঘটনার পেছনে, সকল কথার পেছনে কিছু কথা থেকে যায়, সেই আড়ালের ভাবনা রহস্যময়!

লেখকের মনোযোগ কেবল তার সৃষ্টি-তে। প্রতিবেশী অহংবাদী আচরণ তাকে গ্রাস করতে পারে না বা সেদিকে তার দৃষ্টিপাত করা উচিতও নয়—তবেই লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি হবে আরও সুদৃঢ়, আরও সুতীক্ষ্ণ এবং ধারালো।

৩০. ৫. ২৩

যার কাছে আপনার অনুভূতির কোনো মূল্য নেই। যে বন্ধুটি আপনার দুঃসময়ে আপনাকে এড়িয়ে যাবে সে কখনোই আপনার বন্ধু নয়। জীবনে এমনও সময় আসে, যখন আপনার সকল পরিচিত মানুষ আপনার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে, তখন অলৌকিক শক্তিতে কেউ একজন আপনার পাশে এসে দাঁড়াবে, কাঁধে হাত রেখে বলবে—চিন্তা করো না, আমি আছি তোমার পাশে, সব ঠিক হয়ে যাবে। বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, এই সামান্য সান্ত্বনাটুকু আপনাকে নতুনভাবে শক্তি যোগাবে। আপনি ক্লান্ত মনে আবারও উঠে দাঁড়াবার শক্তি পাবেন। অর্থের চেয়ে কখনো মানুষের সান্ত্বনাই বড়ো ভাগ্যের। কোনো পরিস্থিতিতে পতিত না হলে আপনি সেই পরিস্থিতি সম্পর্কে উপলব্ধি করতে পারবেন না, তাই বলা হয়—(ক্ষেত্রবিশেষে) জ্ঞানীর কাছে নয়, অভিজ্ঞ লোকের কাছে জিজ্ঞেস করো, তবেই সমাধান পাবে।

মায়ের অসুস্থতার সময়ে, হাসপাতালের ক্লান্ত দিনগুলোতে আমি আমার অনেক বন্ধুদের পাশে পাইনি—তবে এমনকিছু সোনালী হৃদয়ের মানুষ পেয়েছিলাম আমি, যারা নিঃস্বার্থভাবে আমার পাশে ছিল, আমাকে সাহস দিয়েছিল, হঠাৎই তারা উদয় হয়েছিল আমাদের দুর্দিনে।

আমি সেই পরিস্থিতিতে পতিত হয়ে শিখেছি মানুষের দুর্দিনে কীভাবে পাশে থাকতে হয়—কীভাবে তাদের সাহস দিতে হয়। তাই অন্যের দুঃখে, অন্যের মন খারাপের দিনগুলোতে তাকে সান্ত্বনা দিন, চুপ থাকুন, কিন্তু উপহাস করা থেকে বিরত থাকুন। ভেঙে পড়া হৃদয়-কে আর কত পোড়াতে চাও তুমি!

মনে রাখা ভালো—অন্যকে কষ্ট দিয়ে, অন্যকে দুঃখ দিয়ে কখনো স্বস্তি পাওয়া যায় না—বরং সেই অহংকারী মনোভাবই আপনাকে নিচে টেনে নামাবে, শুধু সময়ের অপেক্ষা, শুধু সময়ের প্রতিশোধ। আপনাকে তাই এমন এক জীবনাদর্শ বেছে নিতে হবে যেন সামগ্রিক চিন্তার ফলশ্রুতি হয় কেবল সততা।

অন্যের অসহায়ত্বের দিনগুলোতে পাশে থাকার চেষ্টা করুন। হতে পারে এমন দিন আপনার জীবনেও হঠাৎ ঘনিয়ে আসতে পারে।

১. ৬. ২৩

ইলেক্ট্রিসিটি নেই বলে আমাদের পাড়ার মানুষেরা বেরিয়ে পড়েছে খোলা রাস্তায়। গ্রামের এই এক সুবিধা—খালি গায়ে বেরিয়ে পড়া যায়, ঘরের চেয়ে বাইরের হাওয়া আরও শীতল। মনে হয় এই অতিষ্ঠ গরমে একটা পাটি বিছিয়ে সবুজ ঘাসের উপর শুয়ে পড়ি, চাঁদের আলোয় অদ্ভুত মায়া আজ, কেমন যেন শৈশব শৈশব ঘ্রাণ—একদল কিশোর পলান-টু খেলছে আর আমাদের পাড়ার সমস্ত মহিলারা কথা বলছে পরস্পরের সঙ্গে। আমার বড়ো ভালো লাগছে এ দৃশ্য।

কিন্তু যা ঘটছে প্রতিনিয়ত—আমাদের শহরে, আমাদের দেশে, তা জনমানুষের টুঁটি চেপে ধরে রাখা রাষ্ট্রীয় কালো হাত। আগামী জীবন, আমজনতার বিপর্যস্ত জীবনের রূপরেখা তৈরি হচ্ছে এদেশে।

আজ কিছুই করা হলো না—সেদিনের দেখা শাহরুখের ‘স্বদেশ’ এবং ‘ভীর-যারা’ সিনেমার দৃশ্যপট আজও ভাসছে চোখে। বেশ কয়েকটা সিরিজ দেখা হয়েছে এ কদিনে—দাহাদ, খাকি দ্যা বিহার চ্যাপ্টার, বার্ড অফ ব্লাড, আরয়া, বেস্টসেলারসহ আরও কয়েকটা সিনেমা। অবসরের সময়গুলো এভাবেই কাটছে।

আজ কী লিখব কী লিখব ভেবে এটুকুই লেখা হলো। কয়েকদিন পর থেকে টানা ভ্রমণকাহিনী লিখতে হবে, প্রস্তুতি নিচ্ছি। সে পর্যন্ত প্রচুর পড়তে হবে, প্রচুর।

আরও পড়ুন

৯, শান্তি পার্ক, কলকাতা ৭০০০৯৪

৯, শান্তি পার্ক, কলকাতা ৭০০০৯৪

দিনলিপি | ২০ ডিসেম্বর ২০২৩

হসপিটালের পাশেই শান্তি পার্ক কলোনি। এত ছিমছাম সুন্দর গোছানো গলি-তে নাগালের ভেতর রুমভাড়া পেয়ে যাব ভাবিনি। মার্কুইস স্ট্রিটের কালিন কলোনির নোংরা পরিবেশ আর আকাশছোঁয়া হোটেল ভাড়া আমাকে খুবই বিব্রত করে তুলেছিল। সারাদিন ঘুরে-ফিরে অবশেষে এমন এক কলোনিতে এসে পৌঁছেছি, যেখানের রাতগুলো হলুদ আলোয় মোড়ানো—প্রতিটা গলিতে পুরোনো দিনের পাকদণ্ডী মাকড়সার দেয়াল।

তিনদিন হলো এখানে। লেখালেখির সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটেছে যেন—নতুন কিছু লেখা হচ্ছে না। মাথার ভেতর অকথ্য যন্ত্রণা হয় যখন অনেককিছু লিখতে চাই কিন্তু শব্দেরা অযথা দূরে সরে যেতে থাকে।

২.

কখনো কোথাও একই একটা বারান্দা—আমরা চেয়ে আছি নির্বাক আরেকটা বারান্দার দিকে। প্রতিরাতের ঠিক নির্দিষ্ট সময়ে তারা বারান্দায় আসে, তাদের রুমে আলো জ্বলে, একদম ভোরবেলা আবার তারা বেরিয়ে পড়ে। আমরা কোথাও বেরুই না। আমাদের এক আকাশ অবকাশ—তবু আমাদের বাইরের আবহ ভালো লাগে না, অনেক মানুষের সমাগম ভালো লাগে না। এইটুকু, এই একটু ছোট্ট বারান্দায় আমরা লাগিয়েছি একটা মানিপ্লান্ট, আরেকটা ছোট্ট পাত্রে লাগিয়েছি একজোড়া রেইন লিলি।

৩.

আজ আর কিছু নয়। আমরা আমাদের জীবনটাকে এমনভাবে গুছিয়ে নিতে চেয়েছি, যেন কারো সঙ্গে সংঘাত-বিরোধের সৃষ্টি না হয়। কেউ যেন আমাদের দ্বারা মনোকষ্ট না পায়—এবং আমরাও ঠিক ভেবে রেখেছি যেন কেউ আমাদের আঘাত করতে না পারে। জানি এভাবে বেঁচে থাকা সহজ নয়, যতটা সহজ মানুষের পাশে বসে-বসে, চোখে চোখ রেখে মিথ্যে বলা। কতদিন কত শূন্য পথ ফেলে কেউ চলে গিয়েছিল এভাবে। আর কোনোদিন তাকে পাওয়া যায়নি। কখনো ফিরে আসবে কি না কেউ জানে না—তাই এত সংযত জীবনের কথা। খুব বৃষ্টি হলেই কেবল মেঘভাঙা উতল শ্রোত বয়ে যায় এইসব পুরোনো গলিগুলোতে।

৪.

সারাদিন এক অদ্ভুত আমেজ নিয়ে হেঁটেছি আজ। কলেজস্ট্রিটে পুরোনো বইয়ের সন্ধ্যানে, বুদ্ধদেব গুহ’র ‘সবিনয় নিবেদন’, অনুপম রায়ের তিনটে বইসহ আরও বেশ কয়েকটি বই কেনা হলো৷ একটু আগেই ফিরে এলাম বাসায়। তারা এখনো ফেরেনি, হয়তো আরেকটু রাত হলে, আরেকটু অন্ধকার গাঢ় হলে চুপিচুপি আজ তারা ঘরে ফিরবে৷ আমি তাদের প্রতিদিন, একই একটি বারান্দা থেকে দেখতে পাই।

পুরোটা পড়ুন
আমার একাকী রাত্রির বিষন্ন দিনলিপি

আমার একাকী রাত্রির বিষন্ন দিনলিপি

দিনলিপি | ১ সেপ্টেম্বর ২০২৩

৬. ৬. ২৩

মা যে আর নেই—আমি ভাবতেই পারছি না। আমার ভাবতে কষ্ট হচ্ছে—মনে হচ্ছে মা একটু পরই আমাকে কল করে জিজ্ঞেস করবে দুপুরে খেয়েছি কি না, ঠিকঠাক গন্তব্যে পৌঁছেছি কি না—আটটি মাস মা কেমন ধীরে ধীরে ফুরিয়ে যাচ্ছিল, আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি মায়ের শরীরে ভেতর কীভাবে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছে। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে মা—তুমি যে দূর আকাশের তারা হয়ে গিয়েছ, আমাদের বুক চৌচির হয়ে যাচ্ছে। তোমার হাতে রান্না করা আমার প্রিয় টমেটোর চাশনি আর কোনোদিনই খেতে পারব না মা।

মাগো—ও মা! জান্নাতের সবুজ উদ্যানে তুমি আনন্দে থেকো। আল্লাহপাক তোমাকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম দান করুক।

১৫. ৬. ২৩

আমার লিখতে পারার ক্ষমতা ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে কি না বুঝতে পারছি না—তবে আমি লিখতে না পারলে আমার কতিপয় শুভাকাঙ্ক্ষীরা যে দুঃখ পান, আমাকে তারা তা জানায়, তাতে আমারও খুব মন খারাপ হয়। কিন্তু এমন এক সময়ে এসে পৌঁছেছি আমি—আর কোনোদিন সেই অফুরন্ত সময় পাব কি না জানি না৷ সেই যে একা একা আমি বহুরাত অব্দি কোনো একটা গল্প লিখে শেষ করে ফেলতাম, কোনো বই ভালো লেগে গেলে শেষ না করে ঘুমোতে যেতাম না। সারাদিনই আমার অবসর সময় ছিল, কোনো ব্যস্ততা ছিল না, কোনো জঞ্জাল ছিল না চারপাশে। একা একা, অফুরান সময়-কে আলিঙ্গন করে সাহিত্যচর্চা করেছি, প্রতিদিনই নিয়ম করে লিখেছি কিছু না কিছু—সেই সময় হয়তো আমার ফুরিয়ে এসেছে। সেইসব সময় আমি ফেলে এসেছি।

আজ কয়েকদিন যাবৎ দিল্লিতে আছি। এখানকার পরিবেশ, সমাজ এবং সংস্কৃতির সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছি না। তবু আরও একমাস থাকতে হবে এখানে। কত যে কাজ—কত যে ব্যস্ততা।

মায়ের চলে যাওয়ার ভোরে আমি ছিলাম ট্রেনে, রাজধানী এক্সপ্রেসের স্লিপিং সিটে। শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ট্রেন ছেড়েছিল বিকেল চারটা পঞ্চাশে। যখন মায়ের খবর শুনি, তখন পরদিন ভোর পাঁচটা। দিল্লি তখনও বহুদূর—পাঁচঘন্টার পথ, মাঝে আর কোনো স্টেশন নেই। আমার মাথার উপর থেকে কী যেন সরে গেল হঠাৎ, বুকের ভেতর থেকে কী যেন ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল। আমি ভেঙে পড়লাম, চোখের পাতায় লেপ্টে ছিল অজস্র কান্না।

এইযে মায়ের সাথে আমার কতকত স্মৃতি—ভাবলেই আমার বুক ফেটে চৌচির হয়ে যায়। বাড়ি ফিরে কাকে ডাকব মা মা—আর কোনোদিনই মা আমাকে জিজ্ঞেস করবে না, বাবা! বাড়ি এলে কী খাবি বল, পিঠাপুলির দিন এলে কেউ আর জিজ্ঞেস করবে না, বাবা, তোর জন্য পাটিসাপটা বানাব কি না! এইযে এতসব স্মৃতি, মায়ের সাথে আমার চিরবন্ধুতা, এতকিছু একজীবনেও আমি লিখে শেষ করতে পারব না। তবু লিখতে পারছি না। অবশ্যই মা-কে নিয়ে আমি আমার সমস্ত গল্প বলব আপনাদের।

আজ মহান বৃহস্পতিবার—কী হয় এই বৃহস্পতিবারে! কিছুই না। তবু আমাদের অদ্ভুত এক ফ্যাসিনেশন কাজ করে। আমাদের মনে হয়, পৃথিবীর সবচেয়ে স্মৃতিকাতর দিন এ। অথচ এরচেয়েও অনেক অনেক স্মৃতিকাতরতা আছে আমাদের।

আমার জন্য, আমার প্রিয়তম মায়ের জন্য আপনাদের কাছে দোয়া চাই প্রিয়বন্ধুগণ।

২২. ৬. ২৩

আমার মনে হয়—এটুকু বয়সের তুলনায় আমার এত এত দুঃখবোধ জড়ো হয়েছে; ফলত কারো সাথেই এই ভেঙে পড়া মনের কোনো সম্পর্ক নেই। পার্শ্ববর্তী দেশে এসেও প্রতিমুহূর্তে আমার মনে হয়—যদি আমি পাখি হতাম, যদি আমার দুটো ডানা থাকতো, তাহলে এক্ষুনি আমি মায়ের কাছে চলে যেতাম। কিন্তু মা’ও তো নেই—মা চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে আছে আমাকে একা রেখে। আমাকে একা রেখেই মা ঘুমিয়ে পড়েছে। মাগো—তোমার এত জলদি ঘুম পেয়ে যাবে আমি কখনো ভাবিনি, আমার ছোটোখাটো মস্তিষ্কের ভেতর আর কতটুকুই বা ভাববার শক্তি আছে!

আজ কতদিন! বাইশে জুন, আষাঢ়ে ঘনঘটা। আমি ফিরে আসতে চাই তোমার কাছে, তোমার সাথে কতকত গল্প বাকি—আড়ালের কত সত্য তোমাকে বলা হয়নি মা। তবু আশ্বস্ত হতে পারি এটা ভেবে যে, শেষবেলায় তোমাকে আমি একটা নিগূঢ় সত্য বলতে পেরেছি, তুমিও মেনে নিয়েছিলে—বলেছিলে, সুখী হও বাবা।

দেখো—আবারও আজ বৃহস্পতিবার। তোমার অসুস্থ দিনের কথা আমি লিখেছিলাম এমনই কোনো ‘কতিপয় বৃহস্পতির দিনলিপি’-তে। পরবর্তী কোনো বইয়ের পাতায় হয়তো তোমাকে নিয়ে আরও আরও স্মৃতিচারণ থাকবে, সেইসব দিনের কথা কীভাবে বলা হবে আমি জানি না। আমার হাত কাঁপছে মা, আমার বুক কাঁপছে, আমার চোখের পাতা ভিজে যাচ্ছে মা।

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আমার চোখ ছলছল হয়ে থাকে। পরিজন ছেড়ে দূর দেশের ঘিঞ্জি গলির ভেতর একাকী থাকি, আমার বড়ো বিষণ্ণ লাগে। ঢাকা শহরের দূষিত হাওয়ায় বেড়ে ওঠা আমার জীবন—বুড়িগঙ্গার পাড় ঘিরে প্রতিদিনের আসা-যাওয়া যাপনই খুবখুব ভালো ছিল। তবু জীবনের বাঁক ঘোরে, আমাদের উচ্ছল সময়গুলো ফুরিয়ে যায়।

৩০. ৬. ২৩

একাকীত্বের যে বিষণ্ণ বলয়ে আমি বেড়ে উঠেছি—শহরের সবচেয়ে নিঃসঙ্গ সন্ধ্যার চোখও কেঁপে ওঠে এমন আবহে। সারাদিন বৃষ্টি, টিনের চালজুড়ে কীযে জনহীন স্তব্ধতা! কোনো কলরোল নেই কোথাও— জীবনের ফেসিনেশন হ্রাস হয়ে যায় ধীরে ধীরে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মতো বলার সাহস নেই। ‘এই মনোরম মনোটোনাস শহরে অনেক দিন পর আজ সুন্দর বৃষ্টি হলো’ প্রথমত মনোরম, তারপর মনোটোনাস! কী অদ্ভুত! একঘেয়ে বৈচিত্র্যহীনতা-কেও কী সুন্দরভাবে সমন্বিত করা যায়।

তবু এই একাকীত্বের যে করুণ গ্লানি আমরা বয়ে চলি—ফলত প্রায় দিনই আমাদের ঘরে ফিরতে দেরি হয়। কেননা, ঘরে ফিরলেই এক আকাশ শূন্যতা নেমে আসে—তারচেয়ে মোড়ের টঙ-দোকানে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডামুখর সময় কাটালে এইসব দুঃখ ভুলে থাকা যায়। তাই আমরা ঘরে ফিরতে চাই না। আমরা বহুদূর, উদ্দেশ্যহীন হেঁটে যেতে চাই শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে।

অনেক অনেক দিন আগে যখন বৃষ্টি হতো আমাদের গ্রামে—যখন আমার খুব ছোটোবেলা; তখন যেমন আনন্দ হতো, আজ এতগুলো বছর পর, মা আকাশের তারা হয়ে যাবার পর আমাদের জীবনের মোড় ঘুরে গিয়েছে আঁকাবাঁকা পথের সীমানায়। এখন আর বৃষ্টি ভালো লাগে না—শুধু বৃষ্টিই নয়। পৃথিবীর সকল ভালো লাগা মনের ভেতর থেকে উতরে উঠেছে।

আজ সন্ধ্যার পর মনে হলো—ঠিকঠাক লেখাজোঁকা হচ্ছে না। স্বস্তি তো নেই কোথাও, তবু যদি একটু একটু লিখতে পারার ফলে মনটা ঠিক হয়ে আসে...

১. ৭. ২৩

ষোলো সতেরো সালে মাদ্রাসাকেন্দ্রিক সাহিত্যের যে জোয়ার বইছিল তা হঠাৎ করেই, কোনো এক অজানা কারণে স্তব্ধ হয়ে যায়। তখন বিভিন্ন সাহিত্যগ্রুপ, সাহিত্য আড্ডার আয়োজন দেখা যেত সপ্তাহ সপ্তাহ। আমার দেখা সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিল বইপোকাদের আড্ডাখানা, চিঠিপত্র, লিখনসহ আরও অজস্র গ্রুপ। আমি নিজেও কয়েকটা গ্রুপের এডমিন/মডারেটর ছিলাম। এই জাগরণ ছিল খুবই উচ্ছ্বাসের, ছাত্ররাও নিয়মিত লিখত ফেসবুকে। সেসময়কার অনেক অনেক চেনামুখ কালের গহ্বরে তলিয়ে গেছে কেন যেন! আমার খুব মনে পড়ে সেইসব দিনগুলো—যদিও আমি কখনোই কোনো আড্ডায় যেতে পারিনি মুখচোরা স্বভাবের ফলে। তবে এভাবে সাহিত্যের সয়লাভ দেখে খুব আনন্দ হতো মনে।

বেয়ারিং করার সুবাদে বছরখানেক আগে মোহাম্মদপুরে একটা আড্ডার আসর করতাম আমরা, অনেকেই আসতো। আমার খুব ভালো লাগতো সেইসব আড্ডামুখর রাত্রিগুলোতে। কয়েকদিন ধরে নানান বিষয় মনের ভেতর খেলা করতো। শরীরের ভেতর অদ্ভুত এক আমেজ ছিল তখন, সেসব সময়ে।

কিন্তু, এমন দিন এখন—কোথাও দেখি না এমন আয়োজন। সাহিত্য আসরও সেভাবে চোখে পড়ে না আর। আমরা কী আমাদের জীবনের সুকোমল দিনগুলো ফেলে এসেছি এভাবেই! আমি আবারও খুব করে চাই, সপ্তাহ সপ্তাহ না হলেও অন্তত মাসে একবার হলেও যেন কেউকেউ সাহিত্যের আসর করেন। এতে নতুনরা সমৃদ্ধ হবে।

২. ৭. ২৩

দিল্লিতে যে আঠারো দিন আমি ছিলাম—মনে হয়েছিল জাহাজের ডেকে বসে অনন্তকাল ধরে ছুটে চলেছি সমুদ্রের পথে, কবে গন্তব্যে ফিরব, জানা নেই। প্রত্যেকটা দিন আমার অদ্ভুত যন্ত্রণায় কেটেছে। প্রতিদিনই মনে হয়েছে কবে শেষ হবে আমার কাজ—কবে ফিরব দেশে! মায়ের শেষবেলায় না থাকতে পারার তাড়না বয়ে বেড়াই আজও। প্রতি মুহূর্তে মনে হয়, মা অসুস্থ হবার আটটি মাস তার সাথে থাকতে পেরেছি—কিন্তু, বিদায়বেলায় কেন থাকতে পারলাম না! এখনও চারপাশে অধীর নীরবতা নেমে আসে।

মন হালকা রাখার জন্য বিকেল হলেই আমরা শহর থেকে দূরের কোনো রিসোর্টে চলে যেতাম—গলিঘুপচির ভেতর খুব নোংরা পরিবেশ হলেও দিল্লির পথগুলো এত ছায়াঘেরা, বৃক্ষের সারি সারি শামিয়ানা। মন শীতল হয়ে আসে।

খুব করে ভেবেছি—ভ্রমণকাহিনি লিখব, কিন্তু এ যাত্রার অভিজ্ঞতা মোটেও ভালো নয়। পরবর্তীতে যখন যাব, সেসময়ের দীর্ঘ যাপন নিয়ে ভ্রমণকাহিনি আমাকে লিখতেই হবে।

বয়স যত বাড়তে থাকে, ততই মনে হয়—যদি আমাদের জীবনটা শৈশবেই আটকে যেতো। আর যদি বড় না হতাম আমরা! তাহলে এই অদ্ভুত বিভীষিকাময় জীবনের পিছে পিছে দৌঁড়াতে হতো না আর।

৩. ৭. ২৩

আমার কোনো এক লেখায়—হয়তো কোনো এক গদ্যের শরীরের ভেতর লিখেছিলাম একটা নির্জন বেলকনি কীভাবে আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠেছিল। এখনও— আমার উদাস দিনগুলোতে সেই গ্রিলে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকি। আজও এলাম—কী চমৎকার হাওয়া। বেলকনির বাইরে যেসব গাছের ডালপালা এসে গ্রিলগুলো জড়িয়ে ধরেছে, তাদের কী উচ্ছ্বাস আমাকে দেখে! যেন বহুদিন পর দেখা প্রিয় কোনো বন্ধু। আমি তো ওদের বন্ধুই ভাবি। আমার সমস্ত দুঃখের কথা ওরা জানে। আজ জানাতে এসেছি আরও আরও মনোবেদনার কথা।

এটা আমার খালামণিদের বেলকনি—কী সুন্দর নির্জন। বন্ধুত্বের শূন্যতা, মায়ের শূন্যতা, আরও অনেক অনেক শূন্যতা নিয়ে এই নির্জনতার কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে থাকি আমি। খুব দুঃসাহসিক সময়ের প্লাবন এ!

আজ সকালে কিছু সময়ে রোদ উঠেছিল। কাদাটে রাস্তাগুলো শুকাতে শুরু করেছিল, এরই মাঝে আবারও ঝুম বৃষ্টি। কীযে আকাল দিন!

একজন লেখকের শুধুমাত্র শব্দ আর বাক্য ছাড়া আর কোনো হাতিয়ার নেই—তাই আমি ভাবি, কতভাবে, কতরূপে এইসব হাতিয়ার-কে আলুলায়িত করা যায়।

এত সুন্দর একটা চাঁদ উঠেছে আজ—দীর্ঘ এক মরুভূমির মতো মনে হয়, অথবা সমুদ্রের দিগন্ত থেকে উঁকি দেয়া অজস্র স্বপ্ন।

৫. ৭. ২৩

বিশ্বাস ভঙ্গ হতে হতে এমন এক পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে যে, নিজেকেও বিশ্বাস করতে ভুলে গিয়েছি। নিজের শরীর, হয়তো কোনো একটা অঙ্গও একদিন আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে। প্রতিবেশী মানুষের চোখে এত রক্ত, অন্ধকারের ভেতর থেকেও সেই রক্তের লাল ফুটে থাকে। তাই এই জনারণ্য হতে বিচ্ছিন্ন, কোনো শব্দহীন, নীল বন খুঁড়ে খুঁজে পাওয়া অমূল্য বাঙ্কারের ভেতর একা একা দীর্ঘ জীবন যাপন করতে চাই।

যা-কিছু হওয়া শুধুই সিনেমার মতো, তা-কিছুই আমরা ভাবি—মনে হয় এই তো আমার জীবনের কথা। গতকাল আবারও দেখলাম, চতুর্থবারের মতো, আমার প্রিয় সিনেমা ‘চার্লি’ ভবঘুরে জীবনের সোনালি পারদ।

ফেসবুক আমার কাছে লেখালেখির একটা ডায়েরির মতো। যখন যা ইচ্ছে হয়, ভাবনায় যখন যা উঁকি দেয়, এই ডায়েরিতে আমি টুকে রাখি, আমার লেখার পাঠকগণ তাদের অনুভূতি জানালে আমার খুব ভালো লাগে।

আজ খুব নদীর কাছাকাছি গিয়েছিলাম। কীযে অদ্ভুত সাদা-নীল আকাশের দিগন্ত। পেঁজা তুলো হয়ে উড়ছে যেন সাদা সাদা মেঘ নীল অভ্যুত্থানের মাঝে।

যত চাই মন ভালো হয়ে আসুক। ততই নিরানন্দ এসে ভর করে প্রতিদিনের আলপথে—জানি, একদিন সুসময় বয়ে যাবে চারপাশের আকাশে।

২৫. ৭. ২৩

একেবারে হঠাৎ করেই জীবনের মানচিত্র বদলে গেল। কত-কিছুই তো ভেবে রেখেছি, কত-কত স্বপ্নের বালুকণায় বুজে আসে চোখ। দু-তিন বছর আগেকার জীবন আর এখনকার এ জীবনের কোনো মিল খুঁজে পাই না৷ কেমন যেন বাঁধনছেঁড়া আর্তনাদ—এমন তো হবার কথা ছিল না, কখনো ভাবিনি এই সরলরেখার জীবনে দুর্বেদ কালো রাত নেমে আসবে। চতুর্পাশে দুর্দৈব প্রাচীর আর অনেক মুখোশপরা মানুষের সঙ্গে একসাথে অনিশ্চিত যাপনের দিনগুলো। সময় বড়ো অচেনা ঠেকছে আজকাল। কিছুই ভালো লাগে না—যেন পৃথিবীতে আমি একাই এক আদিম শূন্যতা।

পুরোটা পড়ুন
Delhi Days

Delhi Days

দিনলিপি | ১৫ জুন ২০২৩

অ্যা জার্নি বাই ট্রেন—রাজধানী এক্সপ্রেসের সবটুকু অভিজ্ঞতাই আমি কোনো একদিন সেভাবেই লিখব। কলকাতার শিয়ালদহ স্টেশন থেকে দিল্লি পর্যন্ত প্রায় উনিশ ঘন্টার পথযাত্রায় কত কি দেখেছি, কত মানুষের সঙ্গে পরিচয়, এবং মায়ের মৃত্যুর খবর।

১৫. ৬. ২৩

আমার লিখতে পারার ক্ষমতা ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে কি না বুঝতে পারছি না—তবে আমি লিখতে না পারলে আমার কতিপয় শুভাকাঙ্ক্ষীরা যে দুঃখ পান, আমাকে তারা তা জানায়, তাতে আমারও খুব মন খারাপ হয়। কিন্তু এমন এক সময়ে এসে পৌঁছেছি আমি—আর কোনোদিন সেই অফুরন্ত সময় পাব কি না জানি না৷ সেই যে একা একা আমি বহুরাত অব্দি কোনো একটা গল্প লিখে শেষ করে ফেলতাম, কোনো বই ভালো লেগে গেলে শেষ না করে ঘুমোতে যেতাম না। সারাদিনই আমার অবসর সময় ছিল, কোনো ব্যস্ততা ছিল না, কোনো জঞ্জাল ছিল না চারপাশে। একা একা, অফুরান সময়-কে আলিঙ্গন করে সাহিত্যচর্চা করেছি, প্রতিদিনই নিয়ম করে লিখেছি কিছু না কিছু—সেই সময় হয়তো আমার ফুরিয়ে এসেছে। সেইসব সময় আমি ফেলে এসেছি।

আজ কয়েকদিন যাবৎ দিল্লিতে আছি। এখানকার পরিবেশ, সমাজ এবং সংস্কৃতির সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছি না। তবু আরও একমাস থাকতে হবে এখানে। কত যে কাজ—কত যে ব্যস্ততা।

মায়ের চলে যাওয়ার ভোরে আমি ছিলাম ট্রেনে, রাজধানী এক্সপ্রেসের স্লিপিং সিটে। শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ট্রেন ছেড়েছিল বিকেল চারটা পঞ্চাশে। যখন মায়ের খবর শুনি, তখন পরদিন ভোর পাঁচটা। দিল্লি তখনও বহুদূর—পাঁচঘন্টার পথ, মাঝে আর কোনো স্টেশন নেই। আমার মাথার উপর থেকে কী যেন সরে গেল হঠাৎ, বুকের ভেতর থেকে কী যেন ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল। আমি ভেঙে পড়লাম, চোখের পাতায় লেপ্টে ছিল অজস্র কান্না।

এইযে মায়ের সাথে আমার কতকত স্মৃতি—ভাবলেই আমার বুক ফেটে চৌচির হয়ে যায়। বাড়ি ফিরে কাকে ডাকব মা মা—আর কোনোদিনই মা আমাকে জিজ্ঞেস করবে না, বাবা! বাড়ি এলে কী খাবি বল, পিঠাপুলির দিন এলে কেউ আর জিজ্ঞেস করবে না, বাবা, তোর জন্য পাটিসাপটা বানাব কি না! এইযে এতসব স্মৃতি, মায়ের সাথে আমার চিরবন্ধুতা, এতকিছু একজীবনেও আমি লিখে শেষ করতে পারব না। তবু লিখতে পারছি না। অবশ্যই মা-কে নিয়ে আমি আমার সমস্ত গল্প বলব আপনাদের।

আজ মহান বৃহস্পতিবার—কী হয় এই বৃহস্পতিবারে! কিছুই না। তবু আমাদের অদ্ভুত এক ফ্যাসিনেশন কাজ করে। আমাদের মনে হয়, পৃথিবীর সবচেয়ে স্মৃতিকাতর দিন এ। অথচ এরচেয়েও অনেক অনেক স্মৃতিকাতরতা আছে আমাদের।

আমার জন্য, আমার প্রিয়তম মায়ের জন্য আপনাদের কাছে দোয়া চাই প্রিয়বন্ধুগণ।

পুরোটা পড়ুন