মিকাইল নগর মাদ্রাসা ঘিরে যতসব ভৌতিক কাণ্ডকারখানা
গল্প | ১০ ডিসেম্বর ২০২২
কি অদ্ভুত! নিজেই ভুলে যাই নিজের লেখা কোনো ভৌতিক গল্পের প্লট। নানান উপায়ে মনে করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম যে গল্পের শেষে মূলত আমি কী লিখেছিলাম। শুধু এটুকু মনে আছে—আমাদের তিনতলা মাদ্রাসার বাইরের বিশাল বালু মাঠে রাত হলে একরকম শব্দ শুনতে পেতাম—হরর মুভিগুলোতে যেমন আওয়াজ করে অদৃশ্য ভূতেরা, ঠিক তেমনই আওয়াজ। এমন বহু ঘটনার সাক্ষী আমি—আমাদের বর্ষের আহসান-কেও এভাবে ভূতে ধরেছিল। সেই গল্প বলার আগে এটা জানিয়ে রাখা দরকার যে ভূত বলতে কিছু নেই। আমরা অনেকদিন পর, আরেকটু বড়ো ক্লাসে উঠে জানতে পারি, ভূত বলতে কিছু নেই। আছে শুধু জিন।
২.
তার আগে আরেকটা ঘটনা আপনাদের জানাতে চাই। মাদ্রাসায় পড়ার ফলে—মানে আমাদের মিকাইলনগর মাদ্রাসা ছিল এমন এক অজ পাড়াগাঁয়ে, যেখানে লোকবল ছিল একেবারে শূন্য। মাদ্রাসার আশেপাশে কোনো বাড়িঘর নেই। দূরের দিগন্ত যে গ্রাম দেখা যেত—সেটা হিন্দু পাড়া৷ শ্মশানে খারাপ জিন থাকে, হিন্দুদের মন্দিরে থাকে আরও ভয়াবহ জিন, এসব জানার পর’ও আমরা বিকেলবেলা চলে যেতাম হিন্দুপাড়া। কোনো বিকেলে দেখা যেত শ্মশানে আগুন জ্বলছে, বোধহয় কিছুক্ষণ আগেই কাউকে পোড়ানো হয়েছে। এসব আমাদের ভালো লাগত। আসরের পরের সমস্ত দুষ্টমি মাগরিবের পর, পড়ার টেবিলে বসলেই ভাবনাজুড়ে শুধু শ্মশান, জিন আর হিন্দুপাড়ার চিত্রগুলো ভেসে উঠত।
৩.
দু’হাজার আট সাল তখন। একদিন সন্ধ্যায় কামিনী গাছের ফুল ছিঁড়ে ঘ্রাণ শুঁকল বড় ক্লাসের এক ছাত্র। সন্ধ্যার পরই তার পেটব্যথা শুরু হলো—একা একা হাসতে লাগল আর অন্যছাত্রদের গালাগাল করতে লাগল। আমাদের বড়হুজুর, মওলানা ইব্রাহিম সাহেব তখন বুঝতে পারল তার শরীরে জিন ভর করেছে—নানান কায়দা-কানুন করে শেষে জানা গেল কামিনীগাছের যে ফুল সে ছিঁড়েছে, সে-ফুলে জিনেরা বসেছিল। হুজুরের কবিরাজি কাণ্ডকীর্তির ফলে জিনেরা ছেড়ে যেতে বাধ্য হলো।
আরও এক রাতের কথা। সিলেটের ছাত্তার হুজুর একরাতে দেখেন তার মশারির চারপাশে ছোটো ছোটো মানুষেরা ঘুরছে, সবার মাথায় সাদা পাগড়ি, সাদা জুব্বা। পরের দিন হুজুর আমাদের বলেছিল এমন ঘটনা।
৪.
সবচেয়ে রোমাঞ্চকর বলা ভুল হবে। সবসময় আমাদের আতঙ্কিত করে রাখতো আমাদের সহপাঠী আহসান। বোকা-সোকা, গর্দভ ছাত্র হলেও তার ছিল অনেক শক্তি, গায়ের জোরেই সে প্রায় অন্যছাত্রদের সাথে মারপিট করতো। আমরা একদিন ফুটবল খেলা শেষে, মাগরিবের আজান হবে হবে এমন সময় রুমে ফিরে দেখি আহসানের সারা শরীর গুটিয়ে যাচ্ছে আপনা আপনি। হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে, সাপের মতো মুচড়ে যাচ্ছে পুরো শরীর। আমরা সরিষার তেল, মাখতে শুরু করলাম ওর বুকে, পায়ের তালুতে, আর মুষ্টিবদ্ধ হাত খোলার চেষ্টা করলাম। একটু পর সে স্বাভাবিক হলো, কিছু হয়নি বা সে বুঝছে না এতো মানুষ তাকে কেন ঘিরে আছে।
আহসানের শরীরে জিন ভর করে থাকে সবসময়। সেজন্য অন্যান্য ছাত্ররা তার সাথে মেশা বন্ধ করে দিল। আমি একদিন সাহস করে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কেন তার এই সমস্যা হয়! কেন জিনেরা তার শরীরে ভর করে! সে জানাল, বহুদিন আগে, সে তখন অনেক ছোটো। তাদের ধানের ঘরে একরাতে ঘুমিয়েছিল সে, সেরাতে সে দেখে একটা কাফনে মোড়ানো লাশ তাকে ডাকছে। সেই থেকেই তার এমন সমস্যার সূত্রপাত।
কলমাকান্দার পাহাড়ি চূড়ায় এক ধরনের ফল হয়, কৃষ্ণফল। পরীক্ষার ছুটিতে বাড়ি গেলে আহসান এই কৃষ্ণফলের বীজ নিয়ে আসতো মাদ্রাসায়। এর বৈশিষ্ট্য ছিল, অনেকটা এসিডের মতো কাজ করে—শরীরের চামড়ায় সেই বীজ দিয়ে যেকোনো নাম লেখা যায়, বহুদিন পর্যন্ত সেই নাম ফুটে থাকে। সমস্যা হলো, চামড়া একেবারে পুড়ে যায় যায় অবস্থা। আহসান একটা মেয়েকে ভালোবাসত—তার নাম ছিল সুরাইয়া। আহসানের বুকে, বাহুতে কৃষ্ণফলের বীজ দিয়ে লেখা ছিল সুরাইয়ার নাম।
৫.
শুধু আহসান নয়। নবাবগঞ্জের শহীদ ভাইয়ের তারচেয়ে গুরুতর সমস্যা ছিল। শহীদ ভাইকে তার কোনো এক প্রেমিকা তদবির করেছিল তাকে পাওয়ার জন্য। প্রায় রাতে শহীদ ভাই চিৎকার করে উঠত, কখনো সাপ দংশন করতে আসছে বলে ঘুমের ভেতর থেকেই কেঁদে উঠতেন শহীদ ভাই, হাতুড়ি দিয়ে পেটাতে আসছে বলে শহীদ ভাই দিনের বেলাও কখনো ঘুমাতেন না।
এভাবে, আমাদের প্রথমবর্ষের দিনগুলো শহীদ ভাইয়ের জিনের সমস্যা-কে কেন্দ্র করে পেরিয়ে গেল। পরের বছর শহীদ ভাই মাদ্রাসা ছেড়ে চলে গেল। আর কোনোদিন মাদ্রাসার সীমানায় তাকে দেখা যায়নি। অবশ্য তারও প্রায় আট-নয় বছর পর মোহাম্মদপুরের একটা মিষ্টির দোকানে দেখা হয়েছিল শহীদ ভাইয়ের সঙ্গে। শহীদ ভাই এখন সুস্থ।
৬.
তো, আহসানের সমস্যার কোনো সুরাহা হয়েছে কি না তা আর জানা হয়নি। একই মাদ্রাসায় লাগাতার পড়াশোনা আমার ভালো লাগছিল না। ফলত আমি সেই মাদ্রাসা ছেড়ে মোহাম্মদপুর চলে আসি।
শুরুতেই আপনাদের বলেছি—গল্পের মূল প্লট ভুলে যেতে বসেছি আমি। যা-কিছু একটু একটু মনে আছে, তাই আপনাদের বলা হলো। মূল ঘটনা, মূল শিরোনামের বিকল্প হিসেবে আরেকটি ছোটো ঘটনা বলে শেষ করছি।
৭.
আমাদের হিফজখানায় বছরের মাঝামাঝিতে একজন ছাত্র ভর্তি হলো। তার নাম খলিল, আমরা বলতাম ধলা খলিল। খুব ফর্সা চেহারা ছিল ওর—রাঙামাটি থেকে আমাদের মাদ্রাসায় কীভাবে এলো সে, তা কেউ জানতে চায়নি। তবু সে আমাদের নানানরকম গল্প শোনাতো। খানিকটা চাকমা সম্প্রদায়ের মতো চেহারা ছিল খলিলের। প্রায় সময় চুপচাপ থাকতো সে।
তোরো-চৌদ্দ বছর আগেকার মিকাইল মাদ্রাসা আজকের মতো নয়—আশেপাশের খেতখামার পালটেছে, বাড়িঘর উঠেছে, ড্রেজারে ভরাট করা হয়েছে অনেক দিগন্ত।
আমরা সেসময় খেলতাম, তেমনই কোনো বালুর মাঠে—ফুটবলের নেশা ছিল খুব। এখনো সময় পেলে ফুটবল নিয়ে মাঠে নেমে পড়ি।
তো, ধলা খলিল গভীর রাতে ইবাদত করতো, তাহাজ্জুদ পড়তো, সবার আগে উঠে কনকনে শীতের রাতে একাকি পুকুর থেকে অজু সেরে সবার আগে ক্লাসে বসতো। ছাত্ররা তার ভাবভঙ্গিমা দেখে তার নামের সাথে আরেকটা বিশেষণ যুক্ত করে দিল, ধলা পীর।
একরাতে আমরা ফজরের আগে ঘুম থেকে উঠে দেখি আমাদের ধলা পীর নেই। তার বিছানাপত্র, ট্রাংক, জামাকাপড়ও নেই। তখন সব ছাত্ররা বলতে লাগল, ধলা পীর ছিল মূলত জিন। মানুষের ছদ্মবেশে সে আমাদের মাদ্রাসায় এসেছিল হিফজ পড়ার জন্য।
৮.
মিকাইল নগর মাদ্রাসা এবং আমাদের জিনবন্ধু’র সমাগত কৌতূহলের দিন ফুরিয়ে গেল তারপর। জিনদের আসাযাওয়া, উপস্থিতি কমে যেতে লাগল। আমরা দূর গ্রামের মাদ্রাসা ছেড়ে শহরের মাদ্রাসায় যেতে শুরু করলাম।
আরও পড়ুন
যেভাবে কবি হবেন
গল্প | ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪আপনার লেখা আমার খুব ভালো লাগে আতিক ভাই। আমি যে আপনার কত বড় ভক্ত, আমি নিজেও জানি না। আমি খুব কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম। আমার কোন বইটি পড়েছেন? সে আমতা-আমতা করে বলল, এখনো পড়া হয় নাই ভাই। তবে আপনার নাম শুনেছি আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে। শুনেছি আপনি খুব ভালো লেখেন, আপনার ‘মেহেরুন, প্রিয়তম ফুল’ বইটা কোথায় যেন দেখেছিলাম—কিন্তু টাকার অভাবে কিনতে পারি নাই। আপনি হাদিয়া দিলে পড়ে দেখতাম আরকি। আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, আমার লেখা সবার জন্য না। সবাই আমার লেখার ধরণ বুঝতে পারে না, বা সবার জন্য লিখিও না। সে বলল, সমস্যা নাই ভাই, আমি বুঝব, আমার দাদাও লেখালেখি করতো, লেখালেখি আমার রক্তে মিশে আছে। আমি বললাম, আচ্ছা একদিন আমার খানকায় চলে আইসেন। আপনাকে বইটা উপহার দিব।
২.
এক শুক্রবার বিকেলে মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে বেরিয়ে দেখি সেই ছেলেটা—আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কীভাবে এলেন? সে বলল—ভাই, ভক্ত তার পীরের কাছে পৌঁছাতে আর কী লাগে? আমি আপনারে মন থেকে ভালোবাসি। আমার আবেগ আপনার কাছে নিয়ে এসেছে, আমি বললাম খুব ভালো। আমার ছোট্ট একটা রুম তখন, বইয়ে গাদাগাদি, কোনোমতো ছোটো একটা খাট বিছানো। ওকে রুমে নিয়ে গেলাম, সে রুমে ঢুকেই হুলুস্থুল কাণ্ড, ভাই—আপনি আমার গুরু, আমার শিক্ষক আপনি, আমারে আপনি উদ্ধার করেন, আমি আপনার পায়ে ধরি বলেই আমার দু-পা শক্ত করে ধরে ফেলল ও। আমি ভয়ই পেয়ে গেলাম হঠাৎ। আমিও আপনার মতো লেখক হতে চাই গুরু, আমার উপর দয়া করেন। আমারে আপনি লেখক বানায়ে দেন, আমার খুব শখ লেখক হওয়ার। আমি হতচকিত হয়ে পড়লাম, কী অবাক কাণ্ড! আমি ওকে ভালোভাবে বোঝালাম যে, দেখো ভাই, এভাবে হঠাৎ করে লেখক হয়ে ওঠা যায় না। সে বলল, আমি হব ভাই। আমি একটা কবিতার পাণ্ডুলিপি গুছিয়েছি—আপনার দয়া পেলে আগামী বইমেলায় সেটা বই আকারে প্রকাশ করব৷ আমি বললাম, আচ্ছা—তা করা যাবে, কিন্তু তার আগে আমাকে দেখিয়েন পাণ্ডুলিপিটা। সে বলল, গুরুরে না দেখিয়ে মরে গেলেও বই করব না। গুরুর দয়া না নিলে আল্লাহ নারাজ হবে।
আমার বুকশেলফভর্তি বই দেখে ও কয়েকটা বই পড়ার জন্য নিয়ে যেতে চাইল, আমিও অন্য সবার মতো ওকে আমার বাছাই করা বইগুলো থেকে কয়েকটা বইসহ আমার লিখিত চারটা বই দিলাম। দেয়ার সময় বলেছিলাম আমার বইগুলো শুধু উপহার, বাকিগুলো পড়া শেষ হলে যেন অবশ্যই আমাকে ফেরত দিয়ে যায়। যাবার সময় আমার সাথে ফেসবুকেও যুক্ত হয়ে নিল ও।
কিছুদিন পর দেখি আমার থেকে নেয়া সবগুলো বই একসাথে ছবি তুলে পোস্ট করেছে, ক্যাপশনে লিখেছে: শ্রদ্ধেয় গুরু, প্রিয় লেখক আতিক ফারুকের পক্ষ থেকে পাওয়া উপহার। কী আশ্চর্য! আমি খুবই অবাক হলাম—আরে মগা, আমি তো সবগুলো বই তোকে দিইনি, আমি শুধু আমার লিখিত বইগুলো তোকে উপহার দিয়েছিলাম। সেদিনের মতো কিছুই বলিনি আর।
দুয়েকমাস পরই বইমেলার ফলে আমার সম্পাদিত লিটলম্যাগ বেয়ারিঙের কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম সেবার। লেখা সংগ্রহ করা, সম্পাদনা, প্রুফ, এসব নিয়ে একটু দৌঁড়ঝাপ সময় কাটছিল। ফেসবুকে বেয়ারিঙের নতুন প্রচ্ছদ প্রকাশ করার সাথে সাথেই ও আমাকে ম্যাসেজ দিল, বলল, গুরু—আমিও লিখতে চাই বেয়ারিঙে। আমি বললাম এখানে নতুন লেখকদের লেখা খুব কম নেয়া হয়, লেখার মান এখনো আপনার তেমন না। আপনি লিখতে থাকুন, একটা সময়ে আমিই চেয়ে নিব। কিন্তু খুব অনুনয় করার ফলে আমি বললাম, ঠিকাছে মেইলে দিন, কী লিখেছেন দেখি। একি! এতো আমারই লেখা। বুনোফুলের দিন থেকে কাটাছেঁড়া করা লাইন। আমার রাগ, দুঃখ তো হলোই, কিন্তু হাসিও পেল খুব। এবারও কিছু না বলে ওকে পাশ কাটিয়ে গেলাম।
৩.
সামনে বইমেলা। দুয়েক সপ্তাহ বাকি এখনও। হঠাৎ দেখি ও ওর নতুন বইয়ের প্রচ্ছদ ছেড়েছে, ক্যাপশন দিয়েছে—‘গুরু আতিক ফারুক’কে উৎসর্গ করলাম এই বই, অমুক নম্বর স্টলে পাওয়া যাবে, আমিও থাকব অমুক দিন, আমার পাঠকেরা আসেন, দেখা হবে, আমার অটোগ্রাফও পাবেন বই কিনলে’।নিজের প্রতি এত রাগ হলো যে—ভাবলাম ও আমার কাছ থেকেই হয়তো আশকারা পেয়েছে, কাকে এত করে বোঝালাম, শিল্প-সাহিত্যের এত জ্ঞান কাকে দিলাম! খুব মন খারাপ হলো।
৪.
বইমেলা শুরু হলো। ওর বইটাও ছেপে এসেছে। ভাবলাম একটু উলটেপালটে দেখি কী লিখেছে ও—সেই প্রকাশনীতে গিয়ে বইটার খোঁজ করলাম, একি! বই নেই স্টলে, একটু দূরে চোখ পড়তেই দেখি ও আড়াল হয়ে আছে, আমাকে দেখে যেই ছেলের দৌড়ে আসার কথা, সে আমাকে দেখে পালিয়ে বেড়াচ্ছে কেন?
কিছুদিন পর কোনোভাবে বইটা আমার হাতে আসে৷ খুলে দেখি এলাহি কাণ্ড! আমার বড়োদের থেকে শুরু করে অনেক পরিচিত কবিবন্ধুদের একটা করে কবিতা উৎসর্গ করা! চৌত্রিশটা কবিতা চৌত্রিশজন-কে। এবং সবগুলো কবিতাই কারো না কারো কবিতা থেকে কাটাছেঁড়া করা লাইন। মনে মনে বললাম, বা...বা...বা... কেয়া সিন হেঁ!
৫.
শুধু বই প্রকাশই নয়। কিছুদিন পর এক বড়োভাই কল দিয়ে বলল, আতিক! অমুক ছেলেটাকে চেনো? তোমার সাথে খুব ভালো সম্পর্ক আছে বলল। নাম জানতে চেয়ে বিস্মিত হলাম, সেই ছেলেটাই! আমি বড়োভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই কী সমস্যা বলুন!—কী চায় ও? ভাই বলল ও টাকা ধার চাচ্ছে। আমি সোজা কথায় বললাম, কোনোভাবেই ওকে টাকা-পয়সা দিবেন না ভাই! ভাই নরম স্বভাবের মানুষ, না করতে পারেনি, শেষে পাঁচশো টাকা দিল ওকে। আমি আনফ্রেন্ড করে নাম্বারও ব্লক করে দিলাম যেন আমার সাথে আর কোনো যোগাযোগ করতে না পারে। এই ছেলে বিপদজনক আমার জন্য।
কয়েক মাস চলে গেল। একদিন হঠাৎ অচেনা নাম্বার থেকে কল এল—রিসিভ করে শুনি ওর কণ্ঠ, কাঁদছে, জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম—ফেসবুকে কোনো একটা মেয়ের সঙ্গে প্রেম হয়েছিল তার, ফেনীর দাগনভূঞা দেখা করতে গিয়েছিল—কয়েকজন ছেলেপেলে ওকে ধরে মারধর করে টাকাপয়সা যা ছিল সব নিয়ে গিয়েছে, ঢাকায় ফেরারও টাকা নাই, কোনো দোকানের নাম্বার থেকে কল করেছে। কি আর করার! আমি কিছু টাকা পাঠালাম।
পরের বছর বইমেলায়ও দেখা গেল তার আরেকটা বই বেরোল, আমার পরিচিত এক বন্ধু প্রচ্ছদ পাঠাল বইটার। এখন প্রতিবছর মেলায় তার কবিতার বই বের হয়। সে এখন অনেক বড় কবি, যৌথকাব্যগ্রন্থও বের হয় তার অনেক লেখকদের সঙ্গে। নিজের প্রতি ধিক্কার জানাই আমি প্রায়সময়—কী করলাম এতবছর সাহিত্য করে, এতগুলো বই লিখে, একটাও কবিতার বই করতে পারলাম না। হায় আফসোস!
শব্দশূন্য গ্রাম হতে বহুদূর
গল্প | ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩সে আমাকে সেভাবে চেয়েছিল কি না তা কোনোদিন জানতে পারিনি। রূপবতী নারীদের সকল গুণগৌরব মহিমা তার শরীর এবং মনের উপর লেপটে ছিল। এমন উজ্জ্বল তক আর হাসির ঢেউ, চোখের শব্দশূন্য কৌতুহল, অন্যকোনো নারী-কে দেখিনি। আমি তাকে চেয়েছিলাম কি না ঠিক বলতে পারব না—কিন্তু সে ছিল আমার অন্যগত ভরসার একমাত্র আশ্রয়। যার ছায়া দেখলেই, দূর থেকে মনে হতে থাকে হয়তো একটু আগে সে এই পথে হেঁটে গেল, এইতো তার ছায়ার আবহ এখনো হাওয়ায় উড়ছে। আমাদের দেখা হয়েছিল এক সন্ধ্যায়। খালাবাড়ির উঠোনে পলান-টু খেলার সময়। তাকে সেই সন্ধ্যায় দেখে আমার মনে হয়েছিল আঁধারের শরীরে অদ্ভুত আলোর ঝলকানি।
আমি তার নাম জানতে চাই—সে বলে তার নাম শিমুল তুলোর চেয়ে নরম, তার শিমুল ফুল ভালো লাগে বলে সে নিজেই তার নাম রেখেছে ‘শিমুল’—আসল নাম আফসানা। আমাদের সুন্দর সময় কাটে—খালাদের বাড়িতে ঘনঘন আসা-যাওয়া শুরু হয় আমার। আমরা ধীরে ধীরে খুব ভালো বন্ধু হয়ে উঠি।
২.
এক একদিন আমরা গ্রামের ক্ষেতখামার পেরিয়ে বহুদূর হেঁটে যাই, বিকেল হলে সূর্যের বিষণ্ণ রোদ তার ফর্সা চেহারায় রক্তাভ আলো হয়ে ফুটে থাকে, হালকা বাতাসে তার চুল ওড়ে, সেই তেলচুকচুকে চুলের ঘ্রাণ’ও আমি পেতে পারি এমন কাছাকাছি, পাশাপাশি আমরা হাঁটতে থাকি।
পথের সকল ধুলো নিয়ে শীতার্ত হাওয়ার তোড়ে উড়ে আসা একটি বিপদসংকুল ভাবনার দিগন্তে খুব সুন্দর ভালোলাগা যেমন একদিন ফুরিয়ে যেতে জানে তেমনি তোমার আসা যাওয়া পথ প্রতিদিন বদল হতে থাকে আর আমরা ভুলে যাই নির্ভাবনার দিনও কতটা মোহময় সুরধ্বনি তোলে কখনো কোনোদিন সে এসেছিল এভাবে এমন বিপন্ন ফসিলের সন্ধ্যায়। সে আসে আর যায়, যায় আর আসে মনে হয়—কেননা আমাদের চেনাজানার বহুদিন পেরিয়ে যায়, তবু কেউ কাউকে কিচ্ছু বলি না, কোনো ভালোলাগার কথা বা কোনো ভালোবাসার কথা।
৩.
আলমগীর ভাইয়ের বিয়ের দিন ঠিক হয়। আলমগীর ভাই হলো আমার খালাতো ভাই—সেই সুবাদে বিয়ের তারিখ ঠিক হবারও এক সপ্তাহ্ পূর্বে আমি খালাবাড়ি চলে যাই—আমি মূলত খালাবাড়ি-তে যেকোনো ছুতোয় চলে যেতে চাই, কী এক অনুভূতি আমাকে টেনে নিয়ে যায়। আলমগীর ভাই কাজ করত একটা তামার অলঙ্কারের দোকানে, পড়াশোনা বেশিদূর করতে পারেননি। জীবন নিয়ে গভীর কোনো ভাবনা তার ছিল না। জীবনবিমুখী চিন্তার মানুষগুলোকে আমার উদাসীন মনে হয়—এমন নির্ভাবনার মানুষ’ও হতে পারে!
আলমগীর ভাইয়ের বিয়ের দিন আফসানা খুব সুন্দর সাজে। তাকে দেখে আমি আবারও অবাক হয়ে যাই। ফর্সার চেয়ে শ্যামল বর্ণই আমার ভালো লাগে—আফসানার ছিল তেমনই শ্যামল চেহারা আর ঢেউতোলা ভ্রু। আফসানা আমার দিকে এমন দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে, আমার মনে হতে থাকে সে আমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে, আমিও তাকে ভালোবেসে ফেলি এমন অনুভূত কম্পন হতে থাকে বুকের ভেতর।
৪.
তো, আফসানার ডান কাঁধে সেই বিকেলে একটা ঘাসফড়িং অনেকক্ষণ বসে থাকে থির হয়ে—আফসানা তার ভালো লাগার কথা জানায়, বলে এই ফড়িং-কে সে হরিণ নামে জানত, আর আমাকে সে কখনোই সেভাবে ভালোবাসেনি, আমরা শুধু ভালো বন্ধু হতে পারি বলে সে মৃদু হেসে ওঠে। মৃদু অথচ রহস্যময় সেই হাসি আমাকে আরও উদ্যত করে তোলে তার প্রতি।
আমরা হেঁটে যাই—অনেক দূরে হয়তো
শহরের অট্টালিকা, সাদা সাদা বিল্ডিং চোখে পড়ে, মাঝে একটা নদী, নাম মনে নেই। আমরা নদীর পাড় ধরে হাঁটি, আমাদের ভালো লাগে। কিন্তু মনের ভেতর সেই যে উৎকণ্ঠা—একটু কাছে পাবার সেই যে উদ্ভূত রঙিন বিকেল, ভুলতে পারি না।
হায় আফসানা—একদিন সাহস করে আলমগীর ভাইয়ের বউ, মানে আমাদের ভাবি-কে গোপনে গিয়ে জিজ্ঞেস করি আফসানা কেমন মেয়ে! বা কোনো কৌশলে আমার খালামণির কাছে জানতে চাই আফসানা সম্পর্কে। খালা এবং ভাবি একই কথা বলে যে আফসানা আসলে বারোভাতারি, নানান ছেলেদের সঙ্গে তার সম্পর্ক, সে জনে-জনে, জায়গা বেজায়গায় ফষ্টিনষ্টি করে করে বেড়ায়। আমার বিশ্বাস হতে চায় না। সেই শৈশব থেকে আমি সংবেদনশীল, সামান্য কোনো কথা বা কাজের ফলে খুব দুঃখ পাই, মনের ভেতর ক্ষুদ্র পাথর চেপে থাকে যেন তখন।
৫.
আমি যেদিন তার মুখোমুখি হই—তাকে সব জিজ্ঞেস করি যে লোকে যা বলে তা আসলেই বাস্তবিক কি না, সে মুখের উপর না বলে—বলে আমি যদি আর কোনোদিন তাকে এসব কথা জিজ্ঞেস করি, তাহলে সে কখনোই আমার সাথে হাঁটতে বেরুবে না, আমাদের বন্ধুত্ব সেদিনই শেষ হয়ে যাবে। আমার খুব মন খারাপ হয়, আমি তাকে বলি—আমরা ভালো বন্ধু হয়েই থাকতে চাই মূলত।
৬.
একদিন সকাল সকাল সারাগ্রামে গুঞ্জন উঠে যে রজব আলীর মেয়ে আফসানা দক্ষিনপাড়ার একটা ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছে, কোথায় গিয়েছে কেউ জানে না। আফসানাদের বাড়িতে, উঠোনে সকল আত্মীয়স্বজন মুখ গোমড়া করে বসে আছে—আমার খালা আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলে, তোরে তো আগেই কইছিলাম, এই মাইয়া ভালা না, এহন দেখছত, কামডা কী করছে!
আফসানা-কে আমি বিশ্বাস করেছিলাম—তার জন্য আমার মনের একটা কোণ আলগোছে খালি হতে শুরু করেছিল, কিন্তু হলো না। সে হয়তো শব্দশূন্য গ্রাম হতে বহুদূর, বহুদূর চলে গিয়েছিল—কিন্তু কৈশোরের এই ভালোলাগা আজও আমাকে বিষণ্ণ করে তোলে কখনো কখনো।
কিছু অসমাপ্ত, অগল্পের গভীর হতে
গল্প | ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩প্রায় শ্লথ হয়ে এসেছিল সেদিনের বিকেল—সেদিনের শিহরণ যেন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে আজও, কোনো কোনো বিকেলের আবহ ঠিক তেমনই বিস্ময়কর—আমার হারিয়ে ফেলা স্মৃতি, নির্জন গ্রামের উঠোন পেরিয়ে বর্ণিল কৈশোরেরা কীভাবে নগরায়নের পথে অগ্রসর হয়েছিল এবং একটি গল্প কীভাবে বহুদিন পর শব্দিত রূপে ফিরে আসে, হতে পারে এক গল্পকারের গল্পের ভেতর গল্প বা একটি স্বপ্নের ভেতর আরও আরও স্বপ্ন।
২.
মাত্রই টুকটাক লিখতে শিখেছি—দুয়েকটা গল্প’ও লিখেছিলাম লেখালেখির শুরুর সময়ে। তো, একদিন এমন একটা গল্প আমি লিখে ফেলি যা প্রায় বারো পৃষ্ঠায় গিয়ে সমাপ্ত হয়। বারো পৃষ্ঠার হলেও এখানে আমি টুকরো টুকরো কয়েকটা গল্পের সারাংশই বলব আপনাদের। গল্পটা ছিল এমন—তার আগে বলতে চাই, আমি শুধু গল্পটাই বলব আপনাদের। পুরোনো গল্প রূপায়নের তাৎপর্য আমার জানা নেই—তবে ভাষাগত দুর্বলতার ফলে আমাকে তা করতে হচ্ছে। তবে খুব সংক্ষিপ্ত সময়ের মাঝেই আমি আমার মূল বক্তব্য শেষ করব। দয়া করে কেউ মজলিশ ছেড়ে উঠবেন না।
৩.
এক দরিদ্র রিক্সাওয়ালা একদিন তার রিক্সায় একটা সোনার আংটি খুঁজে পায়—কিন্তু সে কাউকে না বলে এই আংটি নিজের কাছেই রেখে দেয়, আশ্চর্যের ব্যাপার হলো আংটিটি পাবার পর থেকেই তার ছোট্ট সংসারে নানাবিধ সমস্যা হতে থাকে—যেমন অভাব বেড়ে গেল, নানান ছোটোখাটো দুর্ঘটনা ঘটতে লাগল৷ দরিদ্র রিক্সাওয়ালা বুঝতেই পারল না যে এই আংটিটার ফলেই তার এ ধরনের সমস্যা হচ্ছে। একদিন তার স্ত্রী জানতে পারে—তারপর তারা একজন কবিরাজের কাছে গিয়ে সকল ঘটনা খুলে বললে কবিরাজ আংটিটা কোনো এতিমখানায় দান করতে বলে। তারপর তাদের আর কোনো সমস্যা হয় না।
আরেকটা গল্প ছিল এমন—
আচ্ছা, সেই গল্পটা ঠিক যেভাবে লিখেছিলাম,
সেভাবেই এখানে তুলে ধরি—ফলত আপনাদের বুঝতে সুবিধা হবে।
‘ঘরে আলো নেই। ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেছে বেশ খানিকক্ষণ আগে। মোমবাতিও নেই; সরফরাজকে দোকানে পাঠানো হয়েছে অনেকক্ষণ হল। এত সময় লাগার কথা না। আকাশে ঘনকালো মেঘ জমেছে। থেমে থেমে গর্জন দিচ্ছে। কখন ঝুরঝুর করে বৃষ্টি নেমে যায় বলা মুশকিল। রাস্তাঘাটের অবস্থা এমনিতেই ভালো না। সামান্য বৃষ্টিতেই স্যাঁতস্যাঁতে পিচ্ছিল হয়ে যায়। মানুষজন চরম দুর্ভোগে পড়ে। ফোনটাও নিয়ে যায়নি; কল করে যে দ্রুত আসতে বলবে সে ব্যবস্থাও নেই।
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়া শুরু হয়েছে। মেঘের গুড়ুমগুড়ুম গর্জনে কেঁপে কেঁপে উঠছে চারপাশ। জানালার পর্দা নড়ছে তীব্রভাবে। হঠাৎ হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকে ঘনান্ধকার রুমে খানিক আলো আছড়ে পড়ছে। বিকট শব্দে রুমের দরোজা বাড়ি খাচ্ছে। গেইটে দারোয়ান সুরুজ মিয়াও নেই। তার স্ত্রী'র অসুখের কথা বলে সেই যে গেল, আসার আর নাম গন্ধ নেই। ছাদের কার্নিশে সুরুজ’কে দিয়ে ঝুলন্ত একটা টবে হাসনাহেনা লাগিয়েছিল গতবছর। কদিন হল রাতের গভীরতার সাথে তাল মিলিয়ে হাসনাহেনাও প্রগাঢ় ঘ্রাণ ছড়ায় চারদিকে। বৃষ্টি নামার সাথে সাথে ঘ্রাণ আরও তীব্র হয়ে ওঠে।
সরফরাজের সাথে বিয়ে হয়েছে মাসকয়েক হল। মা-বাবার অমতে বিয়ে করায় দু’পক্ষের সকলেই তাদের অপর অসন্তুষ্ট। উপায়ন্তর না পেয়ে শহর ছেড়ে এই আমতলিতে সদ্য গড়ে ওঠা মীর আশফাক সাহেবের তিনতলা বাড়ির দ্বিতীয় তলায় উঠেছে তারা। সবমিলিয়ে আশপাশের শান্ত-নিবিড়, সবুজ শ্যামল পরিবেশ তাদের ভালো লাগছে। সমস্যা শুধু যাতায়াত এবং ঘনঘন ইলেক্ট্রিসিটি চলে যাওয়া। এখনো তুমুল বৃষ্টি, বাতাস। দু'তলা থেকে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে রাস্তার অপারে প্রকাণ্ড এক কড়ই ডাল কড়মড় করে ভেঙ্গে রাস্তা অবরোধ করে ফেলল।
রেইনকোট পরিহিত একজন লোক গেইট দিয়ে প্রবেশ করে সোজা দু’তলায় উঠে পড়ল। দরোজায় খটখট শব্দ। হেমন্তিকার মুখে বিরক্তির ছাপ, সারফরাজ-কে ইচ্ছেমতো না শাসালে যেন তার এই প্রবল বিরক্তি, ক্ষোভ শেষ হচ্ছে না। দরোজা খুলেই হেমন্তিকা 'থ'! এই বৃষ্টিস্নাত রাতে অপরিচিত কে এই লোক! ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করতেই লোকটি তড়িঘড়ি করে রুমে ঢুকেই দরোজার ছিটকিনি লাগিয়ে দিল।
পরদিন সকালে পুলিশ মীর আশফাক সাহেবের বাড়ির দু’তলা থেকে একটি লাশ উদ্ধার করে—ফ্যানের সাথে ঝুলন্ত, হেমন্তিকার মৃতদেহ। সরফরাজের কোনো খবর নেই। সেই যে গেল, আর ফিরে আসল না। সবার সন্দেহের তীর সরফরাজের দিকে। পুলিশ সরফরাজকে খুঁজছে, পুলিশ ইন্সপেক্টর অভি রায় তদন্তে নেমেছে। হেমন্তিকার মা-বাবার কাছে খবর পৌঁছলে তারা তড়িঘড়ি করে ছুটে আসে ঘটনাস্থলে। মেয়ের মৃতদেহে তাকিয়ে নিজেকে আর সামলাতে পারলেন না আফসানা বেগম। জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।
সরফরাজের কোনো খোঁজ নেই। মাসকয়েক পর সরফরাজের লাশও খুঁজে পায় পুলিশ। কেন এই খুন—তাও আবার স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে! পুলিশ তদন্ত করছে’।
এ গল্প এখানেই শেষ—কোনো রকমফের করিনি, শুধু গল্পকারের মূল গল্পটাই তুলে ধরা হয়েছে।
৪.
এ গল্পটা ঠিক আমার নয়, আমার পিতার পিতা মরহুম নুরু মিয়ার। নুরু মিয়া ছিলেন গ্রামের সাধারণ একজন কাঠমিস্ত্রী—তার ছিল আটজন সন্তানাদি। যুদ্ধপরবর্তী বাংলাদেশের অবস্থা ছিল ভয়াবহ, সে ইতিহাস আপনারা জানেন। চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের সময় কাঠমিস্ত্রী আটজন সন্তানাদি নিয়ে মহা বিপাকে পড়েন, ভাতের বদলে আলু, আর আলুর বদলে ভাতের মাড় খেয়ে বাঁচতে শুরু করে সেসময়ের মানুষেরা।
তারপর গল্পটা এভাবে এগিয়ে যায় যে দুঃখ কষ্ট আর অনাহারের জীবন শেষ হয়, চালের দাম কমতে থাকে, মানুষ আবারও ভাত খেতে শুরু করে।
৫.
ক্রমশ শ্লথ হয়ে এসেছিল সেদিনের রাত—আরেকটি গল্প খুঁজে পাই পুরোনো খাতায়—
চুপিসারে, রাতের আঁধারে শহরের গলিতে গলিতে আড্ডাবাজ তরুণ দলটিও নিস্তব্ধ হয়ে যায়—তারা ফিসফিস করে কথা বলে, যেন জানালা খুললেই আমি তাদের সব কথা আরও স্পষ্ট শুনতে পাই, কিন্তু না। আমার মনে হতে থাকে তারা সকলে কোনো গোপন সংস্থার প্রতিনিধি—তারপর একদিন রাতে শহরের সেই গলিতেই, একটা ফ্ল্যাটের ভেতর পরিবারের সকলেই খুন হয়—আমি জানি তাদের খুনি কারা, তারা সে সকল লোক, যারা বহুরাত আমার জানালার বাইরে রাত আরেকটু ঘন হয়ে এলে দলবদ্ধ হয়ে চুপিসারে কথা বলত।
তারপর আর কোনোদিনই আমি জানলার পাশে ঘুমোইনি, কেননা জানালার পাশে ঘুমোলেই আমার মনে হয়, হয়তো তারা কোনোদিন জেনে যাবে আমিও তাদের সমস্ত পরিকল্পনা জানি, তখন আমাকেও হত্যা করা হবে।
কিছু অসমাপ্ত, অগল্পের গভীর হতে এ কেমন উদাস হাওয়া, অনেক না বলা কথা, অনেক সন্ত্রস্ত সময়ের কথা, নিমজ্জিত আঁধারে লীন হয়ে যেতে থাকে...