আতিক ফারুক

লেখক

জানুয়ারির দিনলিপি ৩

জানুয়ারির দিনলিপি ৩

দিনলিপি | ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

২১. ১. ২৩

কবি যখন অহংবোধ তাড়িত হয়ে অন্যের লেখা-কে অবমূল্যায়ন করতে থাকে, তখনই তার শিল্পী হয়ে ওঠার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। আমি এমন একজন অন্ধকবি-কে চিনি যে তার ধরণকে শ্রেষ্ঠ মেনে অন্যসব ধরণের প্রতি বিদ্বেষ প্রকাশ করে এবং এ-ও বলে যে, সে তার সমসাময়িক কাউকেই গোনতে চায় না। অথচ সে জানেই না তার ধরণের বাইরেও হাজার রকমের ধরণ হয়ে থাকে। তার শিল্পবোধ আমাকে হতাশ করেছিল সেদিন।

আত্মঅহংবোধ যে বিপথগামী করে তোলে তা বোধহয় তার ছোটো মন জানে না বা তার পাঠ সীমাবদ্ধতা খুবই সংকীর্ণ।

কবিতা কেন—যেকোনো শিল্পের পথ সুদীর্ঘ সাধনার কথা বলে এবং এই পথ লৌকিকতার জঞ্জাল থেকে বহুদূর। আপামর জনতার কাছে নিজের সৃষ্টি-কে যদি শুধু জনপ্রিয়তার জন্য তুলে ধরতে চায় শিল্পী—তবে সেই শিল্পের অবকাঠামোগত শৈলীর সাথে আমার মতদ্বৈধতা আছে৷

লেখকের লেখা নিয়ে পাঠকের অধিকারের কথা বলা হলেও আদতে পাঠক খুব সামান্যই নির্ণয় করতে পারে লেখার সচলায়তন, মান বা মানহীনতা। কালকে অতিক্রম করে যাওয়াই মূলত লেখকের একনিষ্ঠ অনুধ্যান হতে হয়।

*

আজ কি মনে করে এসব কথা বললাম—ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। তবে পাড়াপড়শি কবিদের যে দৌরাত্ম তা শুধু বিস্মিয় নয়, হতাশারও বটে।

আমি কোনোদিন কোনো পাঠকের হাতে আমার লেখার মানদণ্ড তুলে দিইনি—আমি যা লিখি তা কালের পরিক্রমায় স্বল্পসংখ্যক মহান মানুষের দৃষ্টিগোচর হলেও আমার কাজ স্বরণীয় হয়ে থাকবে, যেদিন আরও আরও লিখতে পারব। সাধারণ মানুষের ভাষায়, বলয়ে, তাদের পছন্দে কখনো লিখতে চাইনি। আমি লিখতে চেয়েছি শুধু সেভাবে, যেভাবে আমার মন বলে, ভেতর থেকে আবেগ উতরে বেরিয়ে আসে যেসব কথা, ভাবনার অনুরণন।

২২. ১. ২৩

কতকিছু বদলে যায়। মানুষের শিষ্টতা, বন্ধুত্বের অঙ্গিকার, নিজের চাওয়া-পাওয়ার সীমাক্ষেত্র। বয়স বাড়ার সাথে সাথে কিছু অভ্যাস’ও পালটে যায়—তবু সেই যে মনের ভেতর খুসখুস প্রেমের অনুভূতি, তা থেকে যায় মৃত্যুর অব্দি। কারো প্রতি মোহভঙ্গ হয়ে গেলে, বিশ্বাস ভঙ্গ হয়ে গেলে সেদিকে যেতে ইচ্ছে করে না আর, তেমনিভাবে কারো প্রতি মায়া, মুগ্ধতা, বিশ্বাস, ভালোলাগা কাজ করলে সেই মায়াজাল ছিঁড়ে কখনো আসা যায় না। ফিরে ফিরে মন সেদিকেই ছুটে চলে।

কতগুলো বছর পেরিয়ে গেল—তবু সেরকম অনুভূতিই রয়ে গেল মনের ভেতর। একইরকম মুগ্ধতা, একইরকম ভালোলাগা আজও বরাদ্দ আছে তার জন্য। বোধ করি, আমার এটুকু বাসনা পূরণ হবে একদিন।

এ-তো এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার যে বারবার ভুল করেও নিশ্চলা মানুষের মতোই পঞ্চেন্দ্রিয় অনুভূত শক্তি নিয়ে বেঁচে আছি। ভুল তো হতেই পারে চলার পথে, আমারও তাইই হয়—ভুলোমনা স্বভাবের ফলে কত কি খুইয়েছি ছোট্ট এ জীবনে। তবু বেঁচে থাকার আনন্দ অন্যকিছুর সাথে তুল্য করা যায় না।

২৩. ১. ২৩

এমনকিছু যাতনার কথা থাকে, এমনকিছু ব্যক্তিগত বেদনা ফুঁসলে ওঠে রাতের আঁধারে, যা কাউকে বলা যায় না। জীবনের পটভূমি এমনই নীরব কলরব। ‘ভালো আছ?’ বা ‘ভালো থেকো’ কথারা আর উড়ে আসে না এখানে।

বুকের উপর কেন এই বেদনার পাথর চেপে আছে আজ, জানি না। ভাববার চেষ্টা করি, ব্যর্থ হই, আবারও ভাবতে শুরু করি, আবারও ব্যর্থ হই। তখন মন কেমন কেঁদে ওঠে।

২৪. ১. ২৩

পরমত-অসহিষ্ণু ব্যক্তিদের অনেকটা মনোবৈকল্যের রুপক উপমার সাথে তুলনা করা যায়। পাড়াপড়শি সেইসব মানুষের সংখ্যা একেবারে হাতেগোনা—হাত বাড়ালেই তাদের ছোঁয়া যায়। কিন্তু আমি তাদের ছুঁতে চাই না। পাশ কেটে যাই, বন্ধু হলে সঙ্গ ত্যাগ করি।

তর্ক বির্তক কখনোই আমার পছন্দ না। বিপ্লবী হবার তাড়না কখনো আমি অনুভব করিনি—ফলত, আমাকে বা যারা নিভৃতে থাকতে পছন্দ করে, তাদের বিপ্লবী না হওয়ার ফলে খোঁচাবেন না দয়া করে।

২৫. ১. ২৩

আজ কি মনে করে মনের ভেতর একটা অদ্ভুত স্মৃতি দোল দিয়ে গেল। অনেকবার চেষ্টা করেও মন থেকে সেই অচ্ছুত স্মৃতি সরাতে পারলাম না। যেন আজও, সেদিন বিকেলের সেই সবুজ মাঠের উপর দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার মুহূর্তটুকু ভাসাভাসা স্মৃতি হয়ে ভাবনার আকাশে ডানা মেলে মাত্রই উড়ে গেল।

দিনগুলো এভাবেই কেটে যায়—মাঝেমাঝে মনে হয়, অতীত না থাকলে আর এমন কিইবা আছে যা নিয়ে মানুষ একা একা কাঁদতে এবং হাসতে জানে!

২৬. ১. ২৩

জীবনের এত এত জঞ্জাল, খড়কুটোর মতো খড়খড় শব্দ শুধু। আজ মহান বৃহস্পতিবার। পাণ্ডুলিপি নিয়ে চুক্তি হবার পর থেকে বৃহস্পতিবার এলে মন কেমন উদাস হয়ে ওঠে প্রতীক্ষায়, কবে ছেপে আসবে ‘কতিপয় বৃহস্পতির দিনলিপি’! প্রকাশক জানিয়েছে মেলা শুরু হবার সপ্তাহখানেক পর বই চলে আসবে, তবু আমার বাঁধভাঙা অপেক্ষা।

২৭. ১. ২৩

শুক্রবার আজ। সকাল সকাল সারাদিনের ব্যস্ততা ঝেড়ে ফেলি—দুপুর গড়িয়ে গেলেই শান্তি, নতুন সপ্তাহের শুরু। নতুন এক উদ্যম নিয়ে শনিবারের সকাল শুরু হয়।

বছরের প্রথম মাস শেষ হয়ে যাচ্ছে। হিসেব কষে দেখা গেল আহামরি কিছুই হয়নি এ মাসে, ফেব্রুয়ারি বইমেলা’ও যাবে হম্বিতম্বি করে। মার্চ মাসের আট তারিখ আবারও শবেবরাত, তারপর রোজার মাস। দিনগুলো কেমন করে কেটে যাচ্ছে, খুব মুশকিল সময়।

২৮. ১. ২৩

শীত এল আর গেল এমন মনে হচ্ছে। গতরাতে মশার উতপাত আর গরমে অসহ্য হয়ে ফ্যান ছেড়ে ঘুমিয়েছি। শীত নেই একদম, দুদিন শীতের প্রকোপে জমে যাবার মতো পরিস্থিতি হয়েছিল, এখন সেরকম কিছু হয়েছে বলে মনেই হচ্ছে না। গরম আর শীত, দুইই আমার পছন্দের। তবে নানানরকম শীতের পোশাক পরা যায় বলে শীতই আমার বেশি পছন্দনীয়।

২৯. ১. ২৩

ফজর পড়েই আজ গিয়েছিলাম প্রিয় আরিফ খান সাদ সাহেব হুজুরের সান্নিধ্যে। আমার জীবনে সবচেয়ে বেশি যার কথা, যার সাহস এবং পরামর্শে ব্যাপক উন্নতি লাভ করেছি। তার ছায়া আমার জন্য পরম সৌভাগ্যের। কিছু মানুষের পাশে হাঁটতে পারলেই আনন্দ হয়, নতুন কিছু শেখা যায়, তারচেয়ে সুখকর অনুভূতি তো এটাই যে, হুজুরের কাছাকাছি দু’বছর থাকতে পেরেছিলাম। দিনলিপি, বা আরবী রোজনামচার হাতেখড়ি তার হাত ধরেই শুরু হয়েছিল।

আমার অন্যকোনো এমন শিক্ষক নেই—যাদের সাথে আমার কথা হয় বা কেউ আমার মনে গভীর শ্রদ্ধাশীল হয়ে আছে, দুয়েকজন আছে হয়তোবা—কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষকদেরই আমি উগ্র পেয়েছি। আজ বুঝতে পারি এবং সে সময়ের অবুঝ মন কতকিছু মেনে নিয়েছে তা অনুধাবন হয়।

ভোরের হালকা শীত-হাওয়া আমাদের প্রকম্পিত করে। নদীপাড়ের ওয়াকওয়ে ধরে আমরা হেঁটে চলি। হুজুর কথা বললেন বৈশ্বিক মন্দা থেকে বঙ্গদেশের অ-ব্যবস্থাপনা নিয়ে। আমার ব্যক্তিগত জীবনের সকল অনুযোগ মেলে ধরি গুরুর সম্মুখে। গুরু আমাকে পরামর্শ দেন, আমি তার সকল নির্দেশ মেনে চলি, যেন বাধ্যগত ছাত্রের স্বভাব এখনো ফুরোয়নি।

তারপর ফিরে আসি যখন একটু একটু কুয়াশার আবরণ সরে যেতে শুরু করেছে রোদের কাছে, আর আমার ভাবনায় নতুন সৃষ্টির আলোড়ন।

৩০. ১. ২৩

ছোট্ট একটা বই, রঙিন প্রচ্ছদ, কী অপূর্ব! হাতে ধরতেই মন জুড়িয়ে যায়। নিজের বইপত্তর নিয়ে কথা বলতে গেলে আধখ্যাঁচড়া স্বভাব পেয়ে বসে আমাকে। কেন যেন মনে হয়, নিজের সৃষ্টি নিয়ে কীসের এত কথা! তাই আমার টাইমলাইনজুড়ে আমার বইয়ের কোনো ছবি থাকে না কখনো। সব লুকিয়ে রাখি আর্কাইভে। অনেকেই হয়তো ভাবতে পারেন—এ কেমন কথা! দু’লাইন লিখেই কী ভাব! তাদের ভাববার সংকীর্ণ সীমাবদ্ধতা থেকে তারা ভাবতেই পারেন, আমার তাতে কোনো আপত্তি নেই।

‘যেকোনো স্মৃতির পাশে’ আমার পঞ্চম গদ্যের বই৷ দারুল ইলমের প্রকাশক জাবির ভাই খুব যত্নে আমার তিনফর্মার বইটাকে যেভাবে শিশুর মতো আগলে রেখেছে, ধৈর্য ধরে আমার যা-তা লেখাগুলোর ছোট্ট সংকলন করে বইটাকে ছাপিয়েছে। সেজন্য তার প্রতি কৃতজ্ঞতা, হয়তো সেভাবে বলা হয়নি—আমরা অনেক কিছুই ভুলে যাই, দ্বিধা, নিস্পৃহ উদাসীনতার ফলে মনের অনেক কথাই বলা হয় না৷

*

একটা গল্প লেখা শুরু করেও এগুতে পারলাম না সেভাবে—সময় লাগবে বোধহয়। এমনও হয়েছে যে চারবছর আগেকার কোনো গল্পের কয়েক লাইন কোথাও টুকে রাখা ছিল, কয়েকদিন আগে, মানে চারবছর পর তা লিখে শেষ করেছি। প্লট ছিল, কিন্তু শব্দ বা বাক্যের ঝনঝনানি ছিল না। সেজন্যই মস্তিষ্কে যখন যা আসে, তা টুকে রাখতে হয়, ফলত কোনোদিন তা থেকে শেকড়বাকড় বেরোয়।

সকালে ফজর পড়ে ঘুমিয়েছিলাম, আটটা বাজতেই কি মনে করে ঘুম ভেঙে গেল, বাইরে বেরিয়ে দেখি কী কুয়াশা! রুমের ভেতর’ও হুলুস্থুল করে ঢুকে পড়বে এমন কুয়াশা নেমেছে আজ। কিন্তু সেই তুলনায় একদম শীত নেই, খালি গায়েই কুয়াশায় অনায়াসে হাঁটা যায়৷ দশটা কি এগারোটা বাজতেই কী রোদ!

এখন পড়ছি মুরাকামির ‘নরওয়েজিয়ান উড’ পড়া শেষ হলে জানাব কেমন লাগল! গতরাতে শেষ করেছি প্রিয় জাহিদুর রহিমের কবিতাবই ‘হেমলক সন্ধ্যার গান’ তার ‘কথারা আমার মন’ বা ‘ক্ষণকালের আভাস হতে’ ব্যাখ্যারও অতীত। তার লেখা পড়ি, মুগ্ধ হই এবং বিস্মিত হই।

৩১. ১. ২৩

ঘুমি নিয়ে এত এত মানুষের অভিযোগ! কেউ বলে সারারাত জেগে থাকতে হয়, ঘুম আসে না। চোখের পাতাগুলো কোনোভাবেই পরস্পরকে স্পর্শ করে না, এ এক মহা যন্ত্রণা। অথচ আমার ঘুম নিয়ে কখনো কোনো অভিযোগ ছিল না। গত দু-বছর যাবৎ এমন এক অভ্যাস গড়ে তুলেছি যে চাইলেই দশ মিনিট ঘুমিয়ে নিতে পারি, কোনো কারণে শরীর দুর্বল মনে হলে পাঁচ/দশমিনিট ঘুমিয়ে নিই। যখনই চোখ বন্ধ করি, ঘুম কেমন আদর করে জড়িয়ে ধরে আমাকে। আমার খুব ভালো লাগে।

শুধু ঘুম নয়—যে-কোনো কিছুই অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেলে তা থেকে বেরিয়ে আসা মুশকিল। ভালো অভ্যাস যেমন আছে, তেমনি আছে খারাপ অভ্যাস। সবসময় আমি সুস্থ-সুন্দর অভ্যাস গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। তবু আলস্য শরীর অনেক কিছুই উপেক্ষা করে চলে যায়।

জটিল সব পরিস্থিতি থেকে কীভাবে বেরিয়ে আসা যায়, কীভাবে বড়ো দুর্ঘটনার মুখোমুখি হলে মন-কে শান্ত-স্থির রাখা যায়, সে-রকম চর্চাই করেছি এযাবতকাল। সুন্দর মন এবং বিশুদ্ধ চিন্তার চর্চা, মানুষের সাথে কোনো প্রতিশ্রুতিই যেন ভঙ্গ না হয় সে-রকম নানান অভ্যাস নিজ থেকেই, নিজের ভেতরে, নিজের সাথে বোঝাপড়া করে চলেছি।

ইচ্ছের পাশাপাশি রুচিশীলতার’ও প্রয়োজন। নয়তো শুধু আকাঙ্ক্ষা পূরণের পর তা সঠিকভাবে, শৈল্পিক সৌন্দর্যে উপস্থাপন করা যায় না। জীবন-কে সাজাতে হয় নিজের রুচি এবং ভাবনার মতোই আদর্শিক। তাহলে এই বেঁচে থাকা যে কী অদ্ভুত আলোড়িত করে রাখবে মন এবং শরীর-কে যা আর বলতে হয় না।

৩১. ১. ২৩—খ

বইমেলা শুরু হয়ে যাচ্ছে আগামীকাল থেকে। তবুও কেমন যেন নিরানন্দ, একটু একটু অপ্রতিভ আলো এসে মনের উপর লেপটে আছে। আনন্দের প্রকাশ সহজতর উপায়ে করা যায়, কিন্তু ক্লিশিত হৃদয়ের যে অপার কান্না, তা শুধু লুকিয়েই থাকে, জনারণ্য মানুষের আড়াল হতে বহুদূর।

কোনো উল্লাস নেই এবারের বইমেলা-কে কেন্দ্র করে—নিজেকেই নিভৃতে রাখছি কি না বা এতসব জঞ্জালে ভিড়াতে চাই না বলেই হয়তো এমন অনীহা। বেয়ারিং লিটলম্যাগ চত্বরে স্টল পেল, আমার কোনো আগ্রহ ছিল না, তাশরিফ ভাইয়ের কৃতিত্ব সব।

এবার বই কিনব বেছে বেছে। কয়েকটা বইয়ের তালিকা টুকে রেখেছি, বাকিগুলো মেলার পর বাংলাবাজার থেকে আরও কম কমিশনে কিনব বলে ভেবেছি। পকেটের যা আকাল চলছে—তবু বই কেনার নেশা থেকে বেরুতে চাই না। ধারদেনা করে হলেও তালিকাভূক্ত বইগুলো নিতে হবে।

*

একজন লেখকের যে শক্তি—তা অন্যকারও, অন্যকোনো শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট কি না তা আমার জানা নেই। মাঝেমাঝে নিজেই আশ্চর্য হই—কবেকার কোন লেখা, হতে পারে বহুবছর আগের কোনো লেখা, যা আমিই ভুলে বসে আছি কোথাও কোন পত্রিকায় লিখেছিলাম—তা মফস্বলের কোনো তরুণীর হাতে পৌঁছাল কোনোভাবে—এমনও হতে পারে সেই লেখা তার ভালো লেগে গেল, গভীরভাবে তার ভাবনায় আলোড়ন তোলল। এ শক্তির কথাই আমি বলতে চেয়েছি। যুগযুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী টিকে থাকে যা। কিন্তু সেখানেও কথা আছে, কথার পিঠে কথা তবু থেকে যায়।

একবার আমার এক দূর গ্রামের বন্ধু—তার পুরোনো বুকশেলফ ঘাঁটতে গিয়ে কোনো এক লিটলম্যাগের পৃষ্ঠা উলটে দেখতে পায় আমার লেখা, বহুবছর আগেকার। সে তার ভালো লাগা জানায়—সেদিনই আমার বোধ হয়েছে একজন লেখকের কী অপার শক্তি!

কিন্তু প্রত্যেক সুফলের পাশাপাশি কোনো কেউকেটা থেকেই যায়—লেখকের’ও বিপত্তি আছে, পাঠকদের অপতৎপরতা। অনেকেই তো এমন যে প্রিয় লেখকের প্রতি অতি ভক্তির ফলে অশ্রদ্ধা-ও করে বসে কেউ-কেউ।

আরও পড়ুন

৯, শান্তি পার্ক, কলকাতা ৭০০০৯৪

৯, শান্তি পার্ক, কলকাতা ৭০০০৯৪

দিনলিপি | ২০ ডিসেম্বর ২০২৩

হসপিটালের পাশেই শান্তি পার্ক কলোনি। এত ছিমছাম সুন্দর গোছানো গলি-তে নাগালের ভেতর রুমভাড়া পেয়ে যাব ভাবিনি। মার্কুইস স্ট্রিটের কালিন কলোনির নোংরা পরিবেশ আর আকাশছোঁয়া হোটেল ভাড়া আমাকে খুবই বিব্রত করে তুলেছিল। সারাদিন ঘুরে-ফিরে অবশেষে এমন এক কলোনিতে এসে পৌঁছেছি, যেখানের রাতগুলো হলুদ আলোয় মোড়ানো—প্রতিটা গলিতে পুরোনো দিনের পাকদণ্ডী মাকড়সার দেয়াল।

তিনদিন হলো এখানে। লেখালেখির সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটেছে যেন—নতুন কিছু লেখা হচ্ছে না। মাথার ভেতর অকথ্য যন্ত্রণা হয় যখন অনেককিছু লিখতে চাই কিন্তু শব্দেরা অযথা দূরে সরে যেতে থাকে।

২.

কখনো কোথাও একই একটা বারান্দা—আমরা চেয়ে আছি নির্বাক আরেকটা বারান্দার দিকে। প্রতিরাতের ঠিক নির্দিষ্ট সময়ে তারা বারান্দায় আসে, তাদের রুমে আলো জ্বলে, একদম ভোরবেলা আবার তারা বেরিয়ে পড়ে। আমরা কোথাও বেরুই না। আমাদের এক আকাশ অবকাশ—তবু আমাদের বাইরের আবহ ভালো লাগে না, অনেক মানুষের সমাগম ভালো লাগে না। এইটুকু, এই একটু ছোট্ট বারান্দায় আমরা লাগিয়েছি একটা মানিপ্লান্ট, আরেকটা ছোট্ট পাত্রে লাগিয়েছি একজোড়া রেইন লিলি।

৩.

আজ আর কিছু নয়। আমরা আমাদের জীবনটাকে এমনভাবে গুছিয়ে নিতে চেয়েছি, যেন কারো সঙ্গে সংঘাত-বিরোধের সৃষ্টি না হয়। কেউ যেন আমাদের দ্বারা মনোকষ্ট না পায়—এবং আমরাও ঠিক ভেবে রেখেছি যেন কেউ আমাদের আঘাত করতে না পারে। জানি এভাবে বেঁচে থাকা সহজ নয়, যতটা সহজ মানুষের পাশে বসে-বসে, চোখে চোখ রেখে মিথ্যে বলা। কতদিন কত শূন্য পথ ফেলে কেউ চলে গিয়েছিল এভাবে। আর কোনোদিন তাকে পাওয়া যায়নি। কখনো ফিরে আসবে কি না কেউ জানে না—তাই এত সংযত জীবনের কথা। খুব বৃষ্টি হলেই কেবল মেঘভাঙা উতল শ্রোত বয়ে যায় এইসব পুরোনো গলিগুলোতে।

৪.

সারাদিন এক অদ্ভুত আমেজ নিয়ে হেঁটেছি আজ। কলেজস্ট্রিটে পুরোনো বইয়ের সন্ধ্যানে, বুদ্ধদেব গুহ’র ‘সবিনয় নিবেদন’, অনুপম রায়ের তিনটে বইসহ আরও বেশ কয়েকটি বই কেনা হলো৷ একটু আগেই ফিরে এলাম বাসায়। তারা এখনো ফেরেনি, হয়তো আরেকটু রাত হলে, আরেকটু অন্ধকার গাঢ় হলে চুপিচুপি আজ তারা ঘরে ফিরবে৷ আমি তাদের প্রতিদিন, একই একটি বারান্দা থেকে দেখতে পাই।

পুরোটা পড়ুন
আমার একাকী রাত্রির বিষন্ন দিনলিপি

আমার একাকী রাত্রির বিষন্ন দিনলিপি

দিনলিপি | ১ সেপ্টেম্বর ২০২৩

৬. ৬. ২৩

মা যে আর নেই—আমি ভাবতেই পারছি না। আমার ভাবতে কষ্ট হচ্ছে—মনে হচ্ছে মা একটু পরই আমাকে কল করে জিজ্ঞেস করবে দুপুরে খেয়েছি কি না, ঠিকঠাক গন্তব্যে পৌঁছেছি কি না—আটটি মাস মা কেমন ধীরে ধীরে ফুরিয়ে যাচ্ছিল, আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি মায়ের শরীরে ভেতর কীভাবে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছে। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে মা—তুমি যে দূর আকাশের তারা হয়ে গিয়েছ, আমাদের বুক চৌচির হয়ে যাচ্ছে। তোমার হাতে রান্না করা আমার প্রিয় টমেটোর চাশনি আর কোনোদিনই খেতে পারব না মা।

মাগো—ও মা! জান্নাতের সবুজ উদ্যানে তুমি আনন্দে থেকো। আল্লাহপাক তোমাকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম দান করুক।

১৫. ৬. ২৩

আমার লিখতে পারার ক্ষমতা ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে কি না বুঝতে পারছি না—তবে আমি লিখতে না পারলে আমার কতিপয় শুভাকাঙ্ক্ষীরা যে দুঃখ পান, আমাকে তারা তা জানায়, তাতে আমারও খুব মন খারাপ হয়। কিন্তু এমন এক সময়ে এসে পৌঁছেছি আমি—আর কোনোদিন সেই অফুরন্ত সময় পাব কি না জানি না৷ সেই যে একা একা আমি বহুরাত অব্দি কোনো একটা গল্প লিখে শেষ করে ফেলতাম, কোনো বই ভালো লেগে গেলে শেষ না করে ঘুমোতে যেতাম না। সারাদিনই আমার অবসর সময় ছিল, কোনো ব্যস্ততা ছিল না, কোনো জঞ্জাল ছিল না চারপাশে। একা একা, অফুরান সময়-কে আলিঙ্গন করে সাহিত্যচর্চা করেছি, প্রতিদিনই নিয়ম করে লিখেছি কিছু না কিছু—সেই সময় হয়তো আমার ফুরিয়ে এসেছে। সেইসব সময় আমি ফেলে এসেছি।

আজ কয়েকদিন যাবৎ দিল্লিতে আছি। এখানকার পরিবেশ, সমাজ এবং সংস্কৃতির সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছি না। তবু আরও একমাস থাকতে হবে এখানে। কত যে কাজ—কত যে ব্যস্ততা।

মায়ের চলে যাওয়ার ভোরে আমি ছিলাম ট্রেনে, রাজধানী এক্সপ্রেসের স্লিপিং সিটে। শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ট্রেন ছেড়েছিল বিকেল চারটা পঞ্চাশে। যখন মায়ের খবর শুনি, তখন পরদিন ভোর পাঁচটা। দিল্লি তখনও বহুদূর—পাঁচঘন্টার পথ, মাঝে আর কোনো স্টেশন নেই। আমার মাথার উপর থেকে কী যেন সরে গেল হঠাৎ, বুকের ভেতর থেকে কী যেন ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল। আমি ভেঙে পড়লাম, চোখের পাতায় লেপ্টে ছিল অজস্র কান্না।

এইযে মায়ের সাথে আমার কতকত স্মৃতি—ভাবলেই আমার বুক ফেটে চৌচির হয়ে যায়। বাড়ি ফিরে কাকে ডাকব মা মা—আর কোনোদিনই মা আমাকে জিজ্ঞেস করবে না, বাবা! বাড়ি এলে কী খাবি বল, পিঠাপুলির দিন এলে কেউ আর জিজ্ঞেস করবে না, বাবা, তোর জন্য পাটিসাপটা বানাব কি না! এইযে এতসব স্মৃতি, মায়ের সাথে আমার চিরবন্ধুতা, এতকিছু একজীবনেও আমি লিখে শেষ করতে পারব না। তবু লিখতে পারছি না। অবশ্যই মা-কে নিয়ে আমি আমার সমস্ত গল্প বলব আপনাদের।

আজ মহান বৃহস্পতিবার—কী হয় এই বৃহস্পতিবারে! কিছুই না। তবু আমাদের অদ্ভুত এক ফ্যাসিনেশন কাজ করে। আমাদের মনে হয়, পৃথিবীর সবচেয়ে স্মৃতিকাতর দিন এ। অথচ এরচেয়েও অনেক অনেক স্মৃতিকাতরতা আছে আমাদের।

আমার জন্য, আমার প্রিয়তম মায়ের জন্য আপনাদের কাছে দোয়া চাই প্রিয়বন্ধুগণ।

২২. ৬. ২৩

আমার মনে হয়—এটুকু বয়সের তুলনায় আমার এত এত দুঃখবোধ জড়ো হয়েছে; ফলত কারো সাথেই এই ভেঙে পড়া মনের কোনো সম্পর্ক নেই। পার্শ্ববর্তী দেশে এসেও প্রতিমুহূর্তে আমার মনে হয়—যদি আমি পাখি হতাম, যদি আমার দুটো ডানা থাকতো, তাহলে এক্ষুনি আমি মায়ের কাছে চলে যেতাম। কিন্তু মা’ও তো নেই—মা চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে আছে আমাকে একা রেখে। আমাকে একা রেখেই মা ঘুমিয়ে পড়েছে। মাগো—তোমার এত জলদি ঘুম পেয়ে যাবে আমি কখনো ভাবিনি, আমার ছোটোখাটো মস্তিষ্কের ভেতর আর কতটুকুই বা ভাববার শক্তি আছে!

আজ কতদিন! বাইশে জুন, আষাঢ়ে ঘনঘটা। আমি ফিরে আসতে চাই তোমার কাছে, তোমার সাথে কতকত গল্প বাকি—আড়ালের কত সত্য তোমাকে বলা হয়নি মা। তবু আশ্বস্ত হতে পারি এটা ভেবে যে, শেষবেলায় তোমাকে আমি একটা নিগূঢ় সত্য বলতে পেরেছি, তুমিও মেনে নিয়েছিলে—বলেছিলে, সুখী হও বাবা।

দেখো—আবারও আজ বৃহস্পতিবার। তোমার অসুস্থ দিনের কথা আমি লিখেছিলাম এমনই কোনো ‘কতিপয় বৃহস্পতির দিনলিপি’-তে। পরবর্তী কোনো বইয়ের পাতায় হয়তো তোমাকে নিয়ে আরও আরও স্মৃতিচারণ থাকবে, সেইসব দিনের কথা কীভাবে বলা হবে আমি জানি না। আমার হাত কাঁপছে মা, আমার বুক কাঁপছে, আমার চোখের পাতা ভিজে যাচ্ছে মা।

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আমার চোখ ছলছল হয়ে থাকে। পরিজন ছেড়ে দূর দেশের ঘিঞ্জি গলির ভেতর একাকী থাকি, আমার বড়ো বিষণ্ণ লাগে। ঢাকা শহরের দূষিত হাওয়ায় বেড়ে ওঠা আমার জীবন—বুড়িগঙ্গার পাড় ঘিরে প্রতিদিনের আসা-যাওয়া যাপনই খুবখুব ভালো ছিল। তবু জীবনের বাঁক ঘোরে, আমাদের উচ্ছল সময়গুলো ফুরিয়ে যায়।

৩০. ৬. ২৩

একাকীত্বের যে বিষণ্ণ বলয়ে আমি বেড়ে উঠেছি—শহরের সবচেয়ে নিঃসঙ্গ সন্ধ্যার চোখও কেঁপে ওঠে এমন আবহে। সারাদিন বৃষ্টি, টিনের চালজুড়ে কীযে জনহীন স্তব্ধতা! কোনো কলরোল নেই কোথাও— জীবনের ফেসিনেশন হ্রাস হয়ে যায় ধীরে ধীরে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মতো বলার সাহস নেই। ‘এই মনোরম মনোটোনাস শহরে অনেক দিন পর আজ সুন্দর বৃষ্টি হলো’ প্রথমত মনোরম, তারপর মনোটোনাস! কী অদ্ভুত! একঘেয়ে বৈচিত্র্যহীনতা-কেও কী সুন্দরভাবে সমন্বিত করা যায়।

তবু এই একাকীত্বের যে করুণ গ্লানি আমরা বয়ে চলি—ফলত প্রায় দিনই আমাদের ঘরে ফিরতে দেরি হয়। কেননা, ঘরে ফিরলেই এক আকাশ শূন্যতা নেমে আসে—তারচেয়ে মোড়ের টঙ-দোকানে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডামুখর সময় কাটালে এইসব দুঃখ ভুলে থাকা যায়। তাই আমরা ঘরে ফিরতে চাই না। আমরা বহুদূর, উদ্দেশ্যহীন হেঁটে যেতে চাই শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে।

অনেক অনেক দিন আগে যখন বৃষ্টি হতো আমাদের গ্রামে—যখন আমার খুব ছোটোবেলা; তখন যেমন আনন্দ হতো, আজ এতগুলো বছর পর, মা আকাশের তারা হয়ে যাবার পর আমাদের জীবনের মোড় ঘুরে গিয়েছে আঁকাবাঁকা পথের সীমানায়। এখন আর বৃষ্টি ভালো লাগে না—শুধু বৃষ্টিই নয়। পৃথিবীর সকল ভালো লাগা মনের ভেতর থেকে উতরে উঠেছে।

আজ সন্ধ্যার পর মনে হলো—ঠিকঠাক লেখাজোঁকা হচ্ছে না। স্বস্তি তো নেই কোথাও, তবু যদি একটু একটু লিখতে পারার ফলে মনটা ঠিক হয়ে আসে...

১. ৭. ২৩

ষোলো সতেরো সালে মাদ্রাসাকেন্দ্রিক সাহিত্যের যে জোয়ার বইছিল তা হঠাৎ করেই, কোনো এক অজানা কারণে স্তব্ধ হয়ে যায়। তখন বিভিন্ন সাহিত্যগ্রুপ, সাহিত্য আড্ডার আয়োজন দেখা যেত সপ্তাহ সপ্তাহ। আমার দেখা সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিল বইপোকাদের আড্ডাখানা, চিঠিপত্র, লিখনসহ আরও অজস্র গ্রুপ। আমি নিজেও কয়েকটা গ্রুপের এডমিন/মডারেটর ছিলাম। এই জাগরণ ছিল খুবই উচ্ছ্বাসের, ছাত্ররাও নিয়মিত লিখত ফেসবুকে। সেসময়কার অনেক অনেক চেনামুখ কালের গহ্বরে তলিয়ে গেছে কেন যেন! আমার খুব মনে পড়ে সেইসব দিনগুলো—যদিও আমি কখনোই কোনো আড্ডায় যেতে পারিনি মুখচোরা স্বভাবের ফলে। তবে এভাবে সাহিত্যের সয়লাভ দেখে খুব আনন্দ হতো মনে।

বেয়ারিং করার সুবাদে বছরখানেক আগে মোহাম্মদপুরে একটা আড্ডার আসর করতাম আমরা, অনেকেই আসতো। আমার খুব ভালো লাগতো সেইসব আড্ডামুখর রাত্রিগুলোতে। কয়েকদিন ধরে নানান বিষয় মনের ভেতর খেলা করতো। শরীরের ভেতর অদ্ভুত এক আমেজ ছিল তখন, সেসব সময়ে।

কিন্তু, এমন দিন এখন—কোথাও দেখি না এমন আয়োজন। সাহিত্য আসরও সেভাবে চোখে পড়ে না আর। আমরা কী আমাদের জীবনের সুকোমল দিনগুলো ফেলে এসেছি এভাবেই! আমি আবারও খুব করে চাই, সপ্তাহ সপ্তাহ না হলেও অন্তত মাসে একবার হলেও যেন কেউকেউ সাহিত্যের আসর করেন। এতে নতুনরা সমৃদ্ধ হবে।

২. ৭. ২৩

দিল্লিতে যে আঠারো দিন আমি ছিলাম—মনে হয়েছিল জাহাজের ডেকে বসে অনন্তকাল ধরে ছুটে চলেছি সমুদ্রের পথে, কবে গন্তব্যে ফিরব, জানা নেই। প্রত্যেকটা দিন আমার অদ্ভুত যন্ত্রণায় কেটেছে। প্রতিদিনই মনে হয়েছে কবে শেষ হবে আমার কাজ—কবে ফিরব দেশে! মায়ের শেষবেলায় না থাকতে পারার তাড়না বয়ে বেড়াই আজও। প্রতি মুহূর্তে মনে হয়, মা অসুস্থ হবার আটটি মাস তার সাথে থাকতে পেরেছি—কিন্তু, বিদায়বেলায় কেন থাকতে পারলাম না! এখনও চারপাশে অধীর নীরবতা নেমে আসে।

মন হালকা রাখার জন্য বিকেল হলেই আমরা শহর থেকে দূরের কোনো রিসোর্টে চলে যেতাম—গলিঘুপচির ভেতর খুব নোংরা পরিবেশ হলেও দিল্লির পথগুলো এত ছায়াঘেরা, বৃক্ষের সারি সারি শামিয়ানা। মন শীতল হয়ে আসে।

খুব করে ভেবেছি—ভ্রমণকাহিনি লিখব, কিন্তু এ যাত্রার অভিজ্ঞতা মোটেও ভালো নয়। পরবর্তীতে যখন যাব, সেসময়ের দীর্ঘ যাপন নিয়ে ভ্রমণকাহিনি আমাকে লিখতেই হবে।

বয়স যত বাড়তে থাকে, ততই মনে হয়—যদি আমাদের জীবনটা শৈশবেই আটকে যেতো। আর যদি বড় না হতাম আমরা! তাহলে এই অদ্ভুত বিভীষিকাময় জীবনের পিছে পিছে দৌঁড়াতে হতো না আর।

৩. ৭. ২৩

আমার কোনো এক লেখায়—হয়তো কোনো এক গদ্যের শরীরের ভেতর লিখেছিলাম একটা নির্জন বেলকনি কীভাবে আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠেছিল। এখনও— আমার উদাস দিনগুলোতে সেই গ্রিলে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকি। আজও এলাম—কী চমৎকার হাওয়া। বেলকনির বাইরে যেসব গাছের ডালপালা এসে গ্রিলগুলো জড়িয়ে ধরেছে, তাদের কী উচ্ছ্বাস আমাকে দেখে! যেন বহুদিন পর দেখা প্রিয় কোনো বন্ধু। আমি তো ওদের বন্ধুই ভাবি। আমার সমস্ত দুঃখের কথা ওরা জানে। আজ জানাতে এসেছি আরও আরও মনোবেদনার কথা।

এটা আমার খালামণিদের বেলকনি—কী সুন্দর নির্জন। বন্ধুত্বের শূন্যতা, মায়ের শূন্যতা, আরও অনেক অনেক শূন্যতা নিয়ে এই নির্জনতার কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে থাকি আমি। খুব দুঃসাহসিক সময়ের প্লাবন এ!

আজ সকালে কিছু সময়ে রোদ উঠেছিল। কাদাটে রাস্তাগুলো শুকাতে শুরু করেছিল, এরই মাঝে আবারও ঝুম বৃষ্টি। কীযে আকাল দিন!

একজন লেখকের শুধুমাত্র শব্দ আর বাক্য ছাড়া আর কোনো হাতিয়ার নেই—তাই আমি ভাবি, কতভাবে, কতরূপে এইসব হাতিয়ার-কে আলুলায়িত করা যায়।

এত সুন্দর একটা চাঁদ উঠেছে আজ—দীর্ঘ এক মরুভূমির মতো মনে হয়, অথবা সমুদ্রের দিগন্ত থেকে উঁকি দেয়া অজস্র স্বপ্ন।

৫. ৭. ২৩

বিশ্বাস ভঙ্গ হতে হতে এমন এক পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে যে, নিজেকেও বিশ্বাস করতে ভুলে গিয়েছি। নিজের শরীর, হয়তো কোনো একটা অঙ্গও একদিন আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে। প্রতিবেশী মানুষের চোখে এত রক্ত, অন্ধকারের ভেতর থেকেও সেই রক্তের লাল ফুটে থাকে। তাই এই জনারণ্য হতে বিচ্ছিন্ন, কোনো শব্দহীন, নীল বন খুঁড়ে খুঁজে পাওয়া অমূল্য বাঙ্কারের ভেতর একা একা দীর্ঘ জীবন যাপন করতে চাই।

যা-কিছু হওয়া শুধুই সিনেমার মতো, তা-কিছুই আমরা ভাবি—মনে হয় এই তো আমার জীবনের কথা। গতকাল আবারও দেখলাম, চতুর্থবারের মতো, আমার প্রিয় সিনেমা ‘চার্লি’ ভবঘুরে জীবনের সোনালি পারদ।

ফেসবুক আমার কাছে লেখালেখির একটা ডায়েরির মতো। যখন যা ইচ্ছে হয়, ভাবনায় যখন যা উঁকি দেয়, এই ডায়েরিতে আমি টুকে রাখি, আমার লেখার পাঠকগণ তাদের অনুভূতি জানালে আমার খুব ভালো লাগে।

আজ খুব নদীর কাছাকাছি গিয়েছিলাম। কীযে অদ্ভুত সাদা-নীল আকাশের দিগন্ত। পেঁজা তুলো হয়ে উড়ছে যেন সাদা সাদা মেঘ নীল অভ্যুত্থানের মাঝে।

যত চাই মন ভালো হয়ে আসুক। ততই নিরানন্দ এসে ভর করে প্রতিদিনের আলপথে—জানি, একদিন সুসময় বয়ে যাবে চারপাশের আকাশে।

২৫. ৭. ২৩

একেবারে হঠাৎ করেই জীবনের মানচিত্র বদলে গেল। কত-কিছুই তো ভেবে রেখেছি, কত-কত স্বপ্নের বালুকণায় বুজে আসে চোখ। দু-তিন বছর আগেকার জীবন আর এখনকার এ জীবনের কোনো মিল খুঁজে পাই না৷ কেমন যেন বাঁধনছেঁড়া আর্তনাদ—এমন তো হবার কথা ছিল না, কখনো ভাবিনি এই সরলরেখার জীবনে দুর্বেদ কালো রাত নেমে আসবে। চতুর্পাশে দুর্দৈব প্রাচীর আর অনেক মুখোশপরা মানুষের সঙ্গে একসাথে অনিশ্চিত যাপনের দিনগুলো। সময় বড়ো অচেনা ঠেকছে আজকাল। কিছুই ভালো লাগে না—যেন পৃথিবীতে আমি একাই এক আদিম শূন্যতা।

পুরোটা পড়ুন
Delhi Days

Delhi Days

দিনলিপি | ১৫ জুন ২০২৩

অ্যা জার্নি বাই ট্রেন—রাজধানী এক্সপ্রেসের সবটুকু অভিজ্ঞতাই আমি কোনো একদিন সেভাবেই লিখব। কলকাতার শিয়ালদহ স্টেশন থেকে দিল্লি পর্যন্ত প্রায় উনিশ ঘন্টার পথযাত্রায় কত কি দেখেছি, কত মানুষের সঙ্গে পরিচয়, এবং মায়ের মৃত্যুর খবর।

১৫. ৬. ২৩

আমার লিখতে পারার ক্ষমতা ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে কি না বুঝতে পারছি না—তবে আমি লিখতে না পারলে আমার কতিপয় শুভাকাঙ্ক্ষীরা যে দুঃখ পান, আমাকে তারা তা জানায়, তাতে আমারও খুব মন খারাপ হয়। কিন্তু এমন এক সময়ে এসে পৌঁছেছি আমি—আর কোনোদিন সেই অফুরন্ত সময় পাব কি না জানি না৷ সেই যে একা একা আমি বহুরাত অব্দি কোনো একটা গল্প লিখে শেষ করে ফেলতাম, কোনো বই ভালো লেগে গেলে শেষ না করে ঘুমোতে যেতাম না। সারাদিনই আমার অবসর সময় ছিল, কোনো ব্যস্ততা ছিল না, কোনো জঞ্জাল ছিল না চারপাশে। একা একা, অফুরান সময়-কে আলিঙ্গন করে সাহিত্যচর্চা করেছি, প্রতিদিনই নিয়ম করে লিখেছি কিছু না কিছু—সেই সময় হয়তো আমার ফুরিয়ে এসেছে। সেইসব সময় আমি ফেলে এসেছি।

আজ কয়েকদিন যাবৎ দিল্লিতে আছি। এখানকার পরিবেশ, সমাজ এবং সংস্কৃতির সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছি না। তবু আরও একমাস থাকতে হবে এখানে। কত যে কাজ—কত যে ব্যস্ততা।

মায়ের চলে যাওয়ার ভোরে আমি ছিলাম ট্রেনে, রাজধানী এক্সপ্রেসের স্লিপিং সিটে। শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ট্রেন ছেড়েছিল বিকেল চারটা পঞ্চাশে। যখন মায়ের খবর শুনি, তখন পরদিন ভোর পাঁচটা। দিল্লি তখনও বহুদূর—পাঁচঘন্টার পথ, মাঝে আর কোনো স্টেশন নেই। আমার মাথার উপর থেকে কী যেন সরে গেল হঠাৎ, বুকের ভেতর থেকে কী যেন ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল। আমি ভেঙে পড়লাম, চোখের পাতায় লেপ্টে ছিল অজস্র কান্না।

এইযে মায়ের সাথে আমার কতকত স্মৃতি—ভাবলেই আমার বুক ফেটে চৌচির হয়ে যায়। বাড়ি ফিরে কাকে ডাকব মা মা—আর কোনোদিনই মা আমাকে জিজ্ঞেস করবে না, বাবা! বাড়ি এলে কী খাবি বল, পিঠাপুলির দিন এলে কেউ আর জিজ্ঞেস করবে না, বাবা, তোর জন্য পাটিসাপটা বানাব কি না! এইযে এতসব স্মৃতি, মায়ের সাথে আমার চিরবন্ধুতা, এতকিছু একজীবনেও আমি লিখে শেষ করতে পারব না। তবু লিখতে পারছি না। অবশ্যই মা-কে নিয়ে আমি আমার সমস্ত গল্প বলব আপনাদের।

আজ মহান বৃহস্পতিবার—কী হয় এই বৃহস্পতিবারে! কিছুই না। তবু আমাদের অদ্ভুত এক ফ্যাসিনেশন কাজ করে। আমাদের মনে হয়, পৃথিবীর সবচেয়ে স্মৃতিকাতর দিন এ। অথচ এরচেয়েও অনেক অনেক স্মৃতিকাতরতা আছে আমাদের।

আমার জন্য, আমার প্রিয়তম মায়ের জন্য আপনাদের কাছে দোয়া চাই প্রিয়বন্ধুগণ।

পুরোটা পড়ুন