আতিক ফারুক

লেখক

হে শরমনমিত আশ্চর্য ছায়া ছায়া আলো

হে শরমনমিত আশ্চর্য ছায়া ছায়া আলো

গদ্য | ২৭ নভেম্বর ২০২২

হে রাত্রিঘুম, তুমি দেখো—করতলে ঘর্মাক্ত কবিতার পাশে ঘোমটার আড়ালে কে যেন বসে আছে। এ-তো দিনপঞ্জির কোমল অক্ষর বা আমার লিরিক্যাল গদ্যের উপসংহার। সমস্ত দিনের মায়া ফেলে প্রতিদিন পড়ার টেবিলজুড়ে কবিতার কাটাছেঁড়া—তারপর রাত্রিঘুমের অবসাদ।

হে শরমনমিত আশ্চর্য ছায়া ছায়া আলো! তুমি কি কোনোদিন শুনেছো আমার কান্নার অনুরণন! আমার একটা রঙিন স্বপ্ন আছে—যা অন্ধকার পথের শেষ আলোয় ফুটে ওঠেছে নিরূপিত দেয়ালের শরীরে।

ফুলতোলা ফ্রক পরা বিকেল—মনে আছে। সবকিছু ঠিক সেভাবেই মূর্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আজ নির্বাক পথভোলা পথিকের মতো খুঁজেছি—কে যেন হেঁটে গেল দলছুট শৈশবের স্মৃতি কোলে নিয়ে। সেই চুল, সেই ফ্রক, সূর্যমুখী ফুলের জামা আর শরীরগত অদ্ভুত ঘ্রাণ। আমি জেনেছি, বহুদিন পর আবারও সমস্ত অতীতের খণ্ডাংশ ফিরে আসে—আজ এসেছে যেমন।

নির্ঝর উপবনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে—আজ শুক্রবারের একান্ত অবকাশ। তুমি কোন পথিকের বেশে এসেছিলে। এমন নির্ঘুম চেয়ে থাকা দিনের আলো।

আজ শুক্রবার—আমাদের স্বপ্নেরা একটি জলজ লিলির শরীরে মিশে আছে। কেউ ডাকছে, অনুগত জীবনের জানলায় চলে এসো—যদি পথের সঙ্গী হও। নির্ঝর উপবনে নিদারুণ কোলাহল, ক্রমশ শহরের ভেতর উপশহর, ক্রমশ বনের ভেতর উপবনের কান্না। শুক্রবারের নিমগ্ন দুপুর। আমার রুগ্ন শরীরজুড়ে তুমুল আত্মাহুতি, আমি আর বেশিদিন বাঁচব না। কেমন করে দাঁড়িয়ে থাকে মৃত্যুর অভিলাষ।

এই সকাল ঘিরে রাতের কি ভাবনা—হাওয়াদের ডানায় তুমুল উৎসব—পাখিদের চকিত হুল্লোড়। তোমার চৌকস চোখের পলকে ছুটে চলে একটা অদ্ভুত গ্রাম। সকালের ঝিঙেফুল, সকালের দূর্বাঘাস।

রোদের পরতজুড়ে ছড়িয়ে রাখে অনুরূপ ছায়া। তাই বলে প্রতি সকালেই তোমার কাননে ফুটে ওঠে কেমন মায়া।

তুমি তো পুষ্পকোরক বালিকা—আমার চারপাশে অন্ধ অভিশাপ খেলা করে। গাঁয়ের এঁটেল মাটির পথজুড়ে আজ শুক্রবারের বিপুল অবসাদ। শোনো—

—সবাই চলে যাচ্ছে।
—কোথায়?
—আকাশের লালিমায়।
—সেখানে কিভাবে যাওয়া যায়?
—চোখ বন্ধ করে, পৃথিবী থেকে নিগৃহীত মানুষ সেখানে বসবাস করে।
—তাহলে আমিও যাব।
—জীবনের ডেট এক্সপায়ার না হলে সেখানে যাওয়া যায় না। তুমি হঠাৎ করেই সেখানে যেতে পারো, কিন্তু সেদিন কখন আসে কেউ বলতে পারে না৷ এক অনিশ্চিত লগ্নে তা ঘটে যাবে।
—এই মিথ্যে পৃথিবীতে আমার ভালো লাগে না।
—এই কথা বলো না।
—কেন?
—আমারও ভালো লাগে না। এক অবদমিত হাহাকার সারাক্ষণ আমার মেরুদণ্ড বেয়ে নামতে থাকে।
—তাহলে চলো আমরা হারিয়ে যাই।
—কোথায় হারাব?
—কোনো বনের ভেতর, যেখানে একবার গেলে আর ফিরে আসা যায় না৷
—তা সম্ভব না, আমি তো কোনো সাধু-সন্ন্যাসী হতে পারিনি এখনো, সেজন্য যেতে চাইলেও এই যাবতীয় মোহ-মায়া আমাকে যেতে দিবে না।
—তবুও...
—তবুও একদিন আমি লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যেতে পারি। আমাকে তখন খুঁজে পাবে না। হয়তো তোমার করতলগত নয়, কিন্তু আমি খুব কাছাকাছিই থেকে যাব, দূর থেকে ভালোবেসে যাব কেবল।

দূর আকাশের খানখান নীরবতা আমার হৃদয়ে বেড়ে উঠছে, একটা চা-পাতা ঘ্রাণের পাশে তখন আমি বসে থাকি।

একটা কথা কি জানো—দূরের আলোকিত শহরের মতো তুমি সেখানেই সুন্দর—যেখানে তারার আলোয় ফুটে থাকে সব অভিমান। আমার সংক্ষিপ্ত হাত তোমাকে ছুঁতে পারছে না, তোমাকে বলার মতো নতুন কোনো সংলাপ নেই। একইরকম দুঃখের কথা আর কতদিন বলব—আমি নত হয়ে অনাবৃত চোখের খাঁজে গুঁজে দিই কোনো অসুখের গল্প বা আমার অক্ষমতার গ্লানি।

একটা কথা কি জানো—আমার খুব থৈথৈ স্বপ্ন ছিল। আমার খুব বিষাদের দিন ছিল। কাকে বলি, দুঃখ গিলে খেয়েছি আজ বহুদিন। জানি—কেউ কারো পাশে থাকে না কোনোদিন, কেউ কাউকে ভালোবাসতে পারে না কোনোদিন—শুধু পাশাপাশি হেঁটে যাওয়ার আবদার, শুধু কানে কানে ফিসফিস কথা বলার বাহানা।

একটা কথা কি জানো—এইযে এতরাত এখানে! আমি কাঁদছি না কিন্তু। আমার চোখে বালুকণার জল—জীবনের অপরাপর মন খারাপ বলতে কিছু নেই। কোমল গদগদে দিন আর আসে না আমাদের জীবনে। আমরা হতভাগা পাখিদের খসে পড়া পালকের চেয়েও ক্ষুদ্র। অনেক কথা বলতে চাই—কিন্তু বলতে পারি না। ফুরিয়ে যাওয়া আয়ুর কাল আর কতদিন নিমগ্ন দুপুরের ছায়ায় বসে থাকবে! আমার ভালো লাগে যা—একটা ছায়াঘেরা বাঁশঝাড়, তার পাশেই নদী এবং উৎসন্ন দালানের শ্যাওলা। খুব একা একা এখানেই আমি থেকে যেতে চাই যতদিন বেঁচে আছি। মৃত্যুর খুব নিকটবর্তী সম্ভাবনা নিয়ে আমি এগিয়ে যাচ্ছি সেইসব অন্ধকার সিঁড়ির দেয়ালে—যেখানে লেখা ছিল: আজ আমার মৃত্যুদিন। আজ বলতে কোনদিন! আমি প্রতিদিন তিলে তিলে মরে যাচ্ছি ইঁচড়েপাকা দুপুরের বারান্দায়। খুব বিস্মিত মনে হলেও জানি, চিরসত্য আজীবন উপেক্ষিত। যদি আমার মৃত্যু হয়—আমাকে ভুলে যেয়ো—সমস্ত স্মৃতির পাশে এক অদ্ভুত ঘৃণা জমে আছে।

প্রসঙ্গত বিভ্রম রঙিন সন্ধ্যার ভাঁজে যাকিছু লিপিবদ্ধ—এখানেই ইতি টানছি বলে যে মেয়ে পাতার চিঠিতে লিখেছিল শুধু—ভালো থেকো আকাশের বন্ধু। আমি আর কোনোদিন খুঁজে পাইনি। জানি—যে চলে যায় এভাবে, সে ফিরে আসে না আর। আমাকে কেন একা ফেলে সবাই দূরের তারা হয়ে যায়! আমার দুঃখিত মনের পাশে প্রগলভ স্থিরতা বসে থাকে—যেন তখন রুটি সেঁকা উষ্ণতা খুব মনোরম রূপে আবর্তিত হয়। হেঁয়ালি বিকেলের মতো কোনো অসুস্থ জীবনের দুপেয়ে বিভ্রম পঙ্কিলতার কাছে হেরে যাই—তবু জীবনের এই এমন নিঃসঙ্গতা আমি ভালোবাসি। কেউ পাশে নেই—দূরের খোঁড়ানো স্মৃতিগুলোই আমার বেঁচে থাকার সম্বল। আজনবি বন্ধুটি এভাবেই হারিয়ে যায়—অথচ আমার এমন দিনে তার পাশে থাকার কথা ছিল। আমাদের দুঃখ ভাগাভাগি করে নেয়ার কথা ছিল। আমি জানি—এই পথ শেষ হলে আর এমন কোনো পথ নেই যেখানে আমরা পাশাপাশি খুব সংক্ষেপিত লাজুকতায় হেঁটে যাব বা কোনো মেরুন রঙের ছাই হয়ে উড়ে যাব দূরের হাওয়ায়, যেন তুমি গোপন প্রতিবেশে বেড়ে ওঠা কোনো লেবুফুলের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছো—তোমার শরীরজুড়ে প্রতিবেশী ফুলের ঘ্রাণ। তুমি এসেছিলে এমনই কোনো অবসর যাপিত দিনে—সকালের সুরভিত আবহ যখন আমার এলোমেলো মনের ভেতর ফুটিয়ে তুলেছিল একটা প্রতীক্ষার বটগাছ।

দেখো এই উদ্ভিদের মর্মান্তিক মৃত্যু হল আজ। গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে কেমন ছিন্ন হয়ে গেল একটি ঢেঁড়স আর একটি লাল টমেটো। সেভাবেই যদি আমার মৃত্যু হয় কোনো সবুজ পথের বাঁকে, সিএনজি বা প্রাইভেট কারের চাকায়। তুমি কি খুব কষ্ট পাবে?

তুমি কি কখনো জেনেছো—ভুলে যাওয়ার মতো যন্ত্রণা, প্রতীক্ষার মতো অস্থিরতা নিয়েও তোমার সাথে কেমন নিঃসংশয়ে কথা বলি। যেন আমার কিছুই হয়নি আজ এই শুক্রবারের দিনে—দূরাগত হাওয়ার গানে ফিরে আসি, দূরাগত মায়ার চাদরে জড়িয়ে ধরি তোমাকে। কতদিন প্রতীক্ষায় চেয়ে আছি—কৃষ্ণচূড়ার ছায়াপথজুড়ে দুপুরের ঘুমঘুম আলোড়ন। তবু আমি কোথাও যাব না। আকাশে মেঘ ডাকছে—তোমার জীবনের পরতে পরতে একমাত্র ছায়া, মেঘ এবং একমাত্র রোদ আমি—যেন তুমি গ্রামীণ আবহের মতো বেড়ে উঠছো, আমার চোখের বাঁ পাশে অজানা বিস্ময়।

এই তুমি—আর অধীর ব্যকুলতার কোলে ঘুমিয়ে আছে শ্বাশত সংলাপ। বৃষ্টির ভেজা ভেজা সন্ধ্যায় তুমি এসো না গো। আমি তোমার নামে লিখে ফেলি অজস্র স্মৃতির গান। কোথায় যাব আর—শহরজুড়ে প্রতিদিন একইরকম দুপুর নেমে আসে। গ্রামজুড়ে খাঁ খাঁ রোদ, দূরান্তের সবুজ পেরিয়ে সাদা সাদা মেঘ। আরেকটু পাশ ফিরে যে পথ বেঁকে গেল পরগাছা বনে—সে পথে মিশে আছে আমার জীবন। তুমি কি হেঁটে যাবে সেই সমস্ত নির্জন গ্রামের পথে?

কেউ কি শুনতে পায় আমার এই হুহু কান্না! তুমি তো এমন, উদাস রোদে হেঁটে যাও—খোপায় ফুল গুঁজতে ভুলে যাও। তবু এমন অহংবোধ তাড়িত হওয়া অন্তত তোমার সাথে যায় না। আমি তো তোমাকে মাত্রই ফুটে ওঠা নরম ফুল ভাবি।

—মনের সমস্ত কথা ফুরিয়ে যাচ্ছে—আর কতকাল অপেক্ষায় বসে থাকব বলো?
—পৃথিবীর কাছে আমার এই রুগ্ন জীবনের কোনো মূল্য নেই।
—আমার কাছে তুমি অমূল্য রত্ন।
—এভাবে বলো না, কেমন যেন ছোটো হয়ে আসে আমার জীবন। কেমন যেন কুঁকড়ে যাই।

দেখো—কেউ নেই আজ। কথারা ফুরিয়ে যায় দুপুরের কোলে—তুমি চেয়ে আছো অনেক না বলা স্মৃতির দরোজায়।

আরও পড়ুন

দূর জীবনের এ কেমন পরাভূত হাওয়া

দূর জীবনের এ কেমন পরাভূত হাওয়া

গদ্য | ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

যেকোনো প্রস্থানই অনন্ত বেদনার ছায়া ফেলে চলে যায়। কলকাতা বইমেলার পর্দা নেমে গেল আজ, কী অবাক শীত-শীত আচ্ছন্নতা চারদিকে—কতজন, কত মানুষের সঙ্গে বন্ধুতা হলো। কী হবে? এই হতচ্ছাড়া ছোট্ট পাথরটাকে কতজনই তো ছেড়ে গেছে। একাকি নিছানো অন্ধকারে মুখ থুবড়ে কতদিন কেঁদেছে সে। খুব ক্লিশে যন্ত্রণা। তবু এই চেনা-চেনা মানুষগুলো আমার হৃদয়ে একটা মীনরঙ্গ পাখি হয়ে বহুদিন বেঁচে থাকবে।

মানুষের কাছাকাছি না গেলে কখনোই মানুষকে আবিষ্কার করা যায় না। আমি সবার সঙ্গেই কথা বলি—অনেককিছু শেখা যায়, কৌতূহলী না হলে কখনোই ভিন্নতর সৃষ্টির গতিপথ তৈরি হয় না। আমি কলকাতার প্রায় দু’মাস যাপনের দিনগুলোতে প্রতিদিনই কিছু না কিছু শিখেছি, কখনো পায়ে হেঁটে, কখনো দীঘির পাড়ে পাতানো বেঞ্চে বসে, প্রায় দেখেছি একটা অন্ধ লোকের সঙ্গী একটা নিরীহ কুকুর, যে তাকে পথ দেখায়, বন্ধুর মতোই আগলে রাখে।

We live in a wonderful world that is full of beauty, charm and adventure. There is no end to the adventures we can have if only we seek them with our eyes open.

–Jawaharlal Nehru

আমি এক নতুন পৃথিবী-কে দেখতে চেয়েছি। চোখ-কান খুলে তাকানো নয়, মনের দুয়ার খুলে, শিরধার উঁচু করে তাকাতে চেয়েছি চারপাশে—পাহাড়, সমুদ্র বা আকাশের পাটাতন থেকে খুবলে নিতে চেয়েছি মনের সমস্ত অশুভ দর্পণ।

কী হলো—রাস্তাপারাপারের সময় কার আঙুলের সাথে যেন আমার আঙুল ছুঁয়ে গেল—তার চোখের দিকে চোখ পড়তেই কী অদ্ভুত মায়া খসে পড়ল করুণাময়ী মেট্রো স্টেশনে। আমি সেই দু'খানা আবেগ নিয়ে ফিরে এলাম।

দীপ শেখর চক্রবর্তী, আমার প্রিয় দীপ’দা। মুন্নী সেন, শুভদীপ নায়ক আর শিপ্রা মালাকার, শেষ সময়ের সান্নিধ্য আমাকে এত আনন্দ দিয়েছে আজ। ফেরার পথে শুধু মনে পড়েছে খানিক আগেই তো কিছু একটা ছিল, এখন একেবারেই সুনসান নীরবতা।

তবু যদি—আবারও দেখা হয়ে যায়, কোনোকোনো খেয়ারি সন্ধ্যায়। জীবনের জলপ্রপাত কেবলই নিজেকে জানার। সবকিছু অতিক্রম করে নিজেকে ভালোবাসো, নিজেকে জানো প্রিয়তম বন্ধু, কোনো ভয় নেই, কোনো সঙ্কোচ নেই।

২.

কী হলো—পৃথিবী থমকে দাঁড়িয়েছে না তোমার হস্তরেখায় কে যেন বলেছিল একটা শিশুজন্মের মতো অকথ্য বেদনাবহ সময় তোমারও আসবে। ঠিক তা নয়, হয়তো আমিই আমাকে বলেছিলাম ঘোর স্বপ্নে, এক অজানা বিন্দুবৃত্তের ভেতর। জরাজীর্ণ, লক্ষ্যচ্যুত, অনুতাপ, বেদনা, ক্রমাগত বিচ্ছিন্নতা, বিমর্ষ, কলহ, জঞ্জাল আর এত এত হইহুল্লোড় কখনোই আমি চাইনি।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। কি অপলক দৃষ্টি—আমিই আমাকে দেখতে পাচ্ছি, ঠিক ভেতর-বাইরের অবক্ষিপ্ত নীরবতা যেন। কতদিন নিজের সঙ্গে কথা হয় না। তুমিও দেখো, নিজেকে, ভাবো—কেমন আছো? এদিকটায় খুব শৈত্যপ্রবাহ আজ, তুমি ঘুমিয়ে পড়ো, আয়নার নির্জনতার চেয়ে আর কোনো বিভোর শ্রোতা নেই।

৩.

বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে এলেও মন প’ড়ে থাকে মোহাম্মদপুরের গলি-ঘুপচিতে। ঢাকার তল্লাটে পাথরখচিত রাত ঘিরে চিররহস্যের ঘূর্ণনে সন্ধ্যার উপচে পড়া ভিড় ঠেলে যেন আমি দাঁড়িয়ে আছি ঠিক আসাদগেট মোড়ে। কিন্তু না, আমাকে এক্ষুণি বাসায় যেতে হবে। শান্তিপার্কের ছোট্ট বাসাটা গত দেড়মাস ধরে আমার আশ্রয়, সারাদিন কিছু না হলে লেপটেসেপটে শুয়ে থাকি, জানলার পাশে বসে বই পড়ি, ছোট্ট জানালা খুলে আকাশের দিকে চেয়ে থাকি, কী বিস্ময় লাগে! কী অদ্ভুত এ আকাশ!

কলকাতায় আসার পরদিন থেকে দুর্দান্ত কিছু বই সংগ্রহ করেছি। কলেজস্ট্রিট গেলে খালি হাতে আর ফেরা হয় না। সেই পুরোনো অভ্যেস মস্তিষ্কে ঠেসে গেছে। সেদিন কলকাতা বইমেলায় দীপ’দা, মানে প্রিয় দীপ শেখর চক্রবর্তী’র সঙ্গে এতটা দারুণ সময় কাটিয়েছি। গত দেড় মাসের সবচেয়ে ভালো দিন ছিল আমার জন্যে। তারপর থেকে আজও অব্দি রুম থেকে বেরোয়নি আর, বাইরের এইসব হট্টগোল আমার ভালো লাগে না। যদিও আমাদের কলোনিতে কি যেন অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য আছে—মানুষের নরম ভাষা, হলুদ আলোর করতালি আর একাকি বিষণ্ণ মানুষের নির্জীব কান্না।

দূর জীবনের এ কেমন পরাভূত হাওয়া! বলো।

পুরোটা পড়ুন
শিথানে গদ্যের অপূর্ব ব্যঞ্জনা

শিথানে গদ্যের অপূর্ব ব্যঞ্জনা

গদ্য | ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

শতাব্দীর স্মৃতিচিহ্ন কখনো এরকম এক ঘোরলাগা সময়ের সাথে ছায়াচ্ছন্ন সবুজ অথচ বিবর্ণ দেয়ালঘেঁষা কলকাতার মুখর গলিগুলো আমাকে আবিষ্ট করে রেখেছে। সেই কবে এসেছি, এখনো বেরোয়নি সেভাবে। লিটলম্যাগাজিন মেলায় খুব গোছানো আয়োজন দেখে মন ভালো তো হলো কিন্তু লিটলম্যাগ নিয়ে আমাদের বাংলা একাডেমির কঞ্জুসপনা আমাকে প্রতিবারই হতাশ করে।

ব্যক্তিগত স্বর, সংস্কৃতি, কবিতা আর ফেনিল বৈঠক সেরে কতিপয় কবিবন্ধুদের সঙ্গে আজকের মতো আলোচনা শেষ হলো। দেবারতি মিত্রের প্রয়াণ খুব গভীরভাবেই আমাকে আহত করেছে। কিছুদিন আগেই তার লেখার সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল।

২.

শান্তিপার্কের চারতলার ছোট্ট একটা রুমে আমি, আমার মামাতো ভাই গাদাগাদি করে আছি প্রায় মাসখানেক হলো। কয়েকদিন পেরিয়ে যায় আবদ্ধ রুমে, আমাদের রুমের ছোট্ট জানালা থেকেই আকাশের অবাক করা খণ্ডাংশ চোখে পড়ে, পাশের বিল্ডিংয়ের বেলকনি, ছাদে টানানো রশিতে ঝুলে থাকা নানান রঙের পোশাক, ছাদের কার্নিশে থরে থরে সাজিয়ে রাখা বৃক্ষচারার টব, তাহলে আমি বাইরে বেরিয়ে কোথায় যাব যদি জানালা খোললেই এত মুগ্ধতা ঘনিয়ে আসে।

৩.

একদল অসুস্থ শুয়োর ছড়িয়ে আছে আমার চারপাশে। যারা আমার পথ আটকাতে চায়—ওদের জুতোটপেটা করে বিতাড়িত করলাম আজ। ‘ক্ষতিকারক সবকিছুই বিতাড়িত করতে হবে জীবন থেকে’ এক বিদগ্ধ মনীষী একদা বলেছিল আমাকে।

৪.

এ কোন অশালীন শীত নেমে এলো সারা কলকাতায়—আমার হাত-পা জমে যাচ্ছে। হলুদ আলোয় একপাল অনুগামী তরুণদল তাদের বৃত্তের ভেতর হাঁটছে। অথচ আমার শিথানে গদ্যের অপূর্ব ব্যঞ্জনা।

পুরোটা পড়ুন
ট্রেনের কামরায় হুবহু’র পথচলা

ট্রেনের কামরায় হুবহু’র পথচলা

গদ্য | ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩

অনেকেই হয়তো হুবহু সম্বন্ধে জানতে চায়—অনেক প্রশ্নও জমা হতে পারে, মনে হতে পারে এ আবার কেমন নাম! হুবহু! কিন্তু হুবহু প্রথম সংখ্যা ছেপে আসার পর গড়গড় করে হাজারখানেক কপি ফুরিয়ে গেল কয়েকদিনেই! সম্পাদক হয়ে আমার নিজেরই চক্ষু চড়কগাছ! কেননা, আমি পূর্বে ‘বেয়ারিং’সহ বেশ কয়েকটা লিটলম্যাগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম। বেয়ারিং আমাকে যেটুকু পরিচিত করেছে, যেটুকু সমাদৃত করেছে, হুবহু’র হয়তো সেই সময় এখনো আসেনি। কিন্তু হুবহু শুরু থেকেই আমাকে বেশ পরিতৃপ্ত করেছে। বেয়ারিং নিয়ে এখন আর তেমন ভাবনা নেই। আপাতত চিন্তার পরিবর্তন হয়েছে। আগামীকালের ভাবনা সম্পর্কে বলতে পারছি না।

তো, আমি যখন কয়েকজন সাহিত্যপ্রেমী তরুণের সঙ্গে কমলাপুর থেকে চিটাগং মেইলে চড়ে সীতাকুণ্ডের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলাম। তখন হঠাৎ করেই বহুদিনের জমে থাকা একটা পরিকল্পনা তাদের জানালাম। তারা সবাই আমাকে সাহস দিল, তারা বলল অন্তত তাদের জন্য হলেও যেন কাজটা শুরু করি।

হুবহু প্রকাশ হবার পর থেকে এত এত মানুষ আমাদের প্রশংসা করেছে—শুধু দিনলিপি নিয়ে পূর্বে কোনো কাজ হয়নি, ওপার বাংলার মানুষেরাও আমাকে সাধুবাদ জানিয়েছে এর জন্য। কিন্তু ব্যক্তিগত ব্যস্ততার ফলে হুবহু-কে নিয়মিত সময় দিতে পারছি না বলে আমারও যে দুঃখ হয়।

হুবহু’র শুরু থেকে আজ অব্দি আমার সঙ্গী ছিল এফাজ মোবারক এবং তাশরিফ মাহমুদ। ওদের মতো চঞ্চল তারুণ্য পেয়ে আমি আনন্দিত। সর্বোপরি সবার জন্যই অনেক অনেক ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা।

*লেখাটা কেমন যেন ছাড়াছাড়া। শুধু লিখতে হবে তাই লিখলাম, নয়তো আরও পরিমার্জনা করা যেত। ধন্যবাদ।

পুরোটা পড়ুন