হাসপাতালের দিনলিপি
দিনলিপি | ৩০ নভেম্বর ২০২২
৪. ১০. ২২
মা-কে নিয়ে আগারগাঁও নিউরোসায়েন্সে আসলাম। হাসপাতালে এলে কেমন যেন অস্থির লাগে। চতুর্পাশে অসুস্থ মানুষ, আত্মীয়দের দৌঁড়ঝাপ। আবার কখনো কেউ মারা গেলে হাসপাতালজুড়ে কান্নার জোয়ার।
সিটি স্ক্যানে তেমন কিছু ধরা পড়েনি। কিন্তু অভিজ্ঞ ডক্টর ফিল্মটা দেখেই আমাকে বলল—ডাল মে কুচ কালা হেয়। ডক্টর আমাকে ডামেক বা সোহরাওয়ার্দী-তে নিয়ে যেতে বলল। মা-কে এম্বুলেন্সে করে সোহরাওয়ার্দী নিয়ে আসলাম।
সরকারি হাসপাতালের অবস্থা আরও ভয়াবহ। বড় দুইভাই বিদেশে থাকার ফলে একাই সবকিছু সামাল দিতে হচ্ছে আমার। এমন পরিস্থিতি যেহেতু কখনোই আসেনি, সেহেতু কিছুটা ধকল যাচ্ছে মন আর শরীরের উপর দিয়ে।
ছয়তলায় ডাক্তার রুমের বাইরে ভিড়। বেড খালি নেই। আমাদের ট্রলি নিয়ে আসা মহিলা খুব চেষ্টা তদবির করছে বেড পাওয়ার জন্য। দুই ঘণ্টা পর পাওয়া গেল। সিটি স্ক্যান দেখে ডাক্তার কিছুই বুঝতে পারছে না আসল সমস্যা কোথায়! কয়েকটা রিপোর্ট করাতে বলল পপুলার থেকে। করালাম, কিছুই আসেনি রিপোর্টে।
বড়ভাই, মেজোভাই বিদেশে বসে কাঁদছে।আমি প্রচণ্ড বেদনা নিয়ে এ হাসপাতাল থেকে ও হাসপাতাল, ও হাসপাতাল থেকে এ হাসপাতাল ঘুরে ঘুরে মধ্যরাতে পা ব্যথা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি, পরদিন খুব ভোরে উঠতে হবে ভেবে পরপর পাঁচবার এলার্ম দিয়ে রাখতে হয়। তবু ক্লান্ত শরীর বিছানা ছেড়ে উঠতে চায় না।
৫. ১০. ২২
আজ পাঁচ তারিখ। মা-কে ছয়তলা থেকে শিফট করে একতলা নিউরোসার্জারী-তে আনা হয়েছে। ব্রেণে টিউমার ধরা পড়েছে। খুব বড়ো এবং শক্ত হয়ে গিয়েছে টিউমারটা—ফলত অপারেশন ছাড়া উপায় নেই। তবুও রিস্কি থেকে যায়—শতভাগ নিশ্চিয়তা দিতে পারবে না তারা।
কি এমন দুঃস্বপ্ন দেখেছি আমরা—চতুর্পাশে মেডিসিনের গন্ধ, বারান্দার কার্নিশ বরাবর অপর পাশের রুমের জানলা খোলা, সেখানে লাশকাটা হয়। সরকারি হাসপাতালের নোংরা পরিবেশে অসুস্থ মানুষেরা আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে।
কোনো ডাক্তার আসেনি। পুজোর ছুটি আজ। সরকারি হাসপাতালের কতিপয় ডাক্তারদের আচরণ খুবই নগন্য। রোগী বা রোগীর স্বজনদের সাথে এরা যা আচরণ করে, তা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।
৬. ১০. ২২
ডাক্তার এসেছে আজ। মাঝে একদিন ছুটিতে মনে হয়েছিল পুরো হাসপাতাল নিস্তব্ধ। সকাল বা দুপুরের ভিড়ভাট্টার চেয়ে বিকেল আর রাতের হাসপাতালের করিডরে হুহু হাওয়া বয়ে যায়—কার্নিশে দু’পা ঝুলিয়ে রেখে আমি ভাবতে থাকি মায়ের অসুস্থতার কথা।
ডাক্তারের সাথে কথা বলে জানা গেল তিনমাস পর সিরিয়াল আসবে অপারেশনের। মায়ের অবস্থা দিনদিন খারাপ হতে থাকবে, আর টিউমারটা আরও শক্ত শক্ত হতে থাকবে প্রতিদিন। হামিম কামাল ভাইয়ার সাথে কথা বলে রিশাদ ভাই-কে নক করলাম, রেজওয়ান তানিম ভাই, ফাহাদ ভাইসহ অনেকেই নিয়মিত খোঁজ নিচ্ছে। হাছিব নানাভাবে পাশে থাকার চেষ্টা করছে। মোবারক সার্বক্ষণিক সাথে থাকছে আমার। অনেক বন্ধুরা আবার কোনো খোঁজই নিচ্ছে না। জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত আমাদের শিক্ষিত করে তোলে। যদি সেই শিক্ষিত হয়ে ওঠার চতুরতা থাকে নিজের ভেতর৷
৭. ১০. ২২
আজ শুক্রবার। প্রতিদিনই কোনো না কোনো আত্মীয়স্বজন আসছে—তাদের দেখে মা আরও দুর্বল হয়ে পড়ে, কান্না করে। তবু আমি শক্ত আছি—কারণ, সবকিছু আমাকেই রক্ষণাবেক্ষণ করতে হচ্ছে। বড়ো ভাবি মায়ের সাথেই থাকছে সবসময়।
সকাল থেকে জুমার আগ পর্যন্ত দেদারসে ঘুমিয়েছি। কিন্তু একটু পরপর নানা জনের কলে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। সব আত্মীয়স্বজনের চোখ এখন আমার দিকেই। প্রতিটি পদক্ষেপ খুব বুঝেশুনেই এগুতে হবে।
মোহাম্মদপুরের পথগুলো—চন্দ্রিমা মডেল টাউন থেকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের দূরত্ব প্রতিদিনই একটু একটু কমে যাচ্ছে আমার জন্য। আগের সেই পথের দূরত্ব এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
অনেকদিন দেখা না হওয়া কোনো আত্মীয়র সাথে দেখা হয়ে যাচ্ছে এ উপলক্ষে, যদিও এভাবে হাসপাতালের বেডে দেখা হওয়া আমাদের জন্য আনন্দের নয়। তবু মা তাদের দেখলে একটু শান্তি পান, তার খুব ভালো লাগে।
আগামীকাল অনেক কাজ। পপুলার, নিউরোসায়েন্স, ডিএমসি, ইবনে সিনা-তে গিয়ে কথা বলব। মায়ের অপারেশন যত দ্রুত সময়ে করা যায়—সেখানেই শিফট হব এখান থেকে। দেশে না হলে কলকাতা বা চেন্নাই নিয়ে যাব আমরা। তবুও মা-কে অসুস্থ অবস্থায় দেখে আমাদের মন কাঁদে। আমাদের কোনোকিছুই ভালো লাগে না তখন।
আরও পড়ুন
৯, শান্তি পার্ক, কলকাতা ৭০০০৯৪
দিনলিপি | ২০ ডিসেম্বর ২০২৩হসপিটালের পাশেই শান্তি পার্ক কলোনি। এত ছিমছাম সুন্দর গোছানো গলি-তে নাগালের ভেতর রুমভাড়া পেয়ে যাব ভাবিনি। মার্কুইস স্ট্রিটের কালিন কলোনির নোংরা পরিবেশ আর আকাশছোঁয়া হোটেল ভাড়া আমাকে খুবই বিব্রত করে তুলেছিল। সারাদিন ঘুরে-ফিরে অবশেষে এমন এক কলোনিতে এসে পৌঁছেছি, যেখানের রাতগুলো হলুদ আলোয় মোড়ানো—প্রতিটা গলিতে পুরোনো দিনের পাকদণ্ডী মাকড়সার দেয়াল।
তিনদিন হলো এখানে। লেখালেখির সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটেছে যেন—নতুন কিছু লেখা হচ্ছে না। মাথার ভেতর অকথ্য যন্ত্রণা হয় যখন অনেককিছু লিখতে চাই কিন্তু শব্দেরা অযথা দূরে সরে যেতে থাকে।
২.
কখনো কোথাও একই একটা বারান্দা—আমরা চেয়ে আছি নির্বাক আরেকটা বারান্দার দিকে। প্রতিরাতের ঠিক নির্দিষ্ট সময়ে তারা বারান্দায় আসে, তাদের রুমে আলো জ্বলে, একদম ভোরবেলা আবার তারা বেরিয়ে পড়ে। আমরা কোথাও বেরুই না। আমাদের এক আকাশ অবকাশ—তবু আমাদের বাইরের আবহ ভালো লাগে না, অনেক মানুষের সমাগম ভালো লাগে না। এইটুকু, এই একটু ছোট্ট বারান্দায় আমরা লাগিয়েছি একটা মানিপ্লান্ট, আরেকটা ছোট্ট পাত্রে লাগিয়েছি একজোড়া রেইন লিলি।
৩.
আজ আর কিছু নয়। আমরা আমাদের জীবনটাকে এমনভাবে গুছিয়ে নিতে চেয়েছি, যেন কারো সঙ্গে সংঘাত-বিরোধের সৃষ্টি না হয়। কেউ যেন আমাদের দ্বারা মনোকষ্ট না পায়—এবং আমরাও ঠিক ভেবে রেখেছি যেন কেউ আমাদের আঘাত করতে না পারে। জানি এভাবে বেঁচে থাকা সহজ নয়, যতটা সহজ মানুষের পাশে বসে-বসে, চোখে চোখ রেখে মিথ্যে বলা। কতদিন কত শূন্য পথ ফেলে কেউ চলে গিয়েছিল এভাবে। আর কোনোদিন তাকে পাওয়া যায়নি। কখনো ফিরে আসবে কি না কেউ জানে না—তাই এত সংযত জীবনের কথা। খুব বৃষ্টি হলেই কেবল মেঘভাঙা উতল শ্রোত বয়ে যায় এইসব পুরোনো গলিগুলোতে।
৪.
সারাদিন এক অদ্ভুত আমেজ নিয়ে হেঁটেছি আজ। কলেজস্ট্রিটে পুরোনো বইয়ের সন্ধ্যানে, বুদ্ধদেব গুহ’র ‘সবিনয় নিবেদন’, অনুপম রায়ের তিনটে বইসহ আরও বেশ কয়েকটি বই কেনা হলো৷ একটু আগেই ফিরে এলাম বাসায়। তারা এখনো ফেরেনি, হয়তো আরেকটু রাত হলে, আরেকটু অন্ধকার গাঢ় হলে চুপিচুপি আজ তারা ঘরে ফিরবে৷ আমি তাদের প্রতিদিন, একই একটি বারান্দা থেকে দেখতে পাই।
আমার একাকী রাত্রির বিষন্ন দিনলিপি
দিনলিপি | ১ সেপ্টেম্বর ২০২৩৬. ৬. ২৩
মা যে আর নেই—আমি ভাবতেই পারছি না। আমার ভাবতে কষ্ট হচ্ছে—মনে হচ্ছে মা একটু পরই আমাকে কল করে জিজ্ঞেস করবে দুপুরে খেয়েছি কি না, ঠিকঠাক গন্তব্যে পৌঁছেছি কি না—আটটি মাস মা কেমন ধীরে ধীরে ফুরিয়ে যাচ্ছিল, আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি মায়ের শরীরে ভেতর কীভাবে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছে। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে মা—তুমি যে দূর আকাশের তারা হয়ে গিয়েছ, আমাদের বুক চৌচির হয়ে যাচ্ছে। তোমার হাতে রান্না করা আমার প্রিয় টমেটোর চাশনি আর কোনোদিনই খেতে পারব না মা।
মাগো—ও মা! জান্নাতের সবুজ উদ্যানে তুমি আনন্দে থেকো। আল্লাহপাক তোমাকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম দান করুক।
১৫. ৬. ২৩
আমার লিখতে পারার ক্ষমতা ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে কি না বুঝতে পারছি না—তবে আমি লিখতে না পারলে আমার কতিপয় শুভাকাঙ্ক্ষীরা যে দুঃখ পান, আমাকে তারা তা জানায়, তাতে আমারও খুব মন খারাপ হয়। কিন্তু এমন এক সময়ে এসে পৌঁছেছি আমি—আর কোনোদিন সেই অফুরন্ত সময় পাব কি না জানি না৷ সেই যে একা একা আমি বহুরাত অব্দি কোনো একটা গল্প লিখে শেষ করে ফেলতাম, কোনো বই ভালো লেগে গেলে শেষ না করে ঘুমোতে যেতাম না। সারাদিনই আমার অবসর সময় ছিল, কোনো ব্যস্ততা ছিল না, কোনো জঞ্জাল ছিল না চারপাশে। একা একা, অফুরান সময়-কে আলিঙ্গন করে সাহিত্যচর্চা করেছি, প্রতিদিনই নিয়ম করে লিখেছি কিছু না কিছু—সেই সময় হয়তো আমার ফুরিয়ে এসেছে। সেইসব সময় আমি ফেলে এসেছি।
আজ কয়েকদিন যাবৎ দিল্লিতে আছি। এখানকার পরিবেশ, সমাজ এবং সংস্কৃতির সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছি না। তবু আরও একমাস থাকতে হবে এখানে। কত যে কাজ—কত যে ব্যস্ততা।
মায়ের চলে যাওয়ার ভোরে আমি ছিলাম ট্রেনে, রাজধানী এক্সপ্রেসের স্লিপিং সিটে। শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ট্রেন ছেড়েছিল বিকেল চারটা পঞ্চাশে। যখন মায়ের খবর শুনি, তখন পরদিন ভোর পাঁচটা। দিল্লি তখনও বহুদূর—পাঁচঘন্টার পথ, মাঝে আর কোনো স্টেশন নেই। আমার মাথার উপর থেকে কী যেন সরে গেল হঠাৎ, বুকের ভেতর থেকে কী যেন ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল। আমি ভেঙে পড়লাম, চোখের পাতায় লেপ্টে ছিল অজস্র কান্না।
এইযে মায়ের সাথে আমার কতকত স্মৃতি—ভাবলেই আমার বুক ফেটে চৌচির হয়ে যায়। বাড়ি ফিরে কাকে ডাকব মা মা—আর কোনোদিনই মা আমাকে জিজ্ঞেস করবে না, বাবা! বাড়ি এলে কী খাবি বল, পিঠাপুলির দিন এলে কেউ আর জিজ্ঞেস করবে না, বাবা, তোর জন্য পাটিসাপটা বানাব কি না! এইযে এতসব স্মৃতি, মায়ের সাথে আমার চিরবন্ধুতা, এতকিছু একজীবনেও আমি লিখে শেষ করতে পারব না। তবু লিখতে পারছি না। অবশ্যই মা-কে নিয়ে আমি আমার সমস্ত গল্প বলব আপনাদের।
আজ মহান বৃহস্পতিবার—কী হয় এই বৃহস্পতিবারে! কিছুই না। তবু আমাদের অদ্ভুত এক ফ্যাসিনেশন কাজ করে। আমাদের মনে হয়, পৃথিবীর সবচেয়ে স্মৃতিকাতর দিন এ। অথচ এরচেয়েও অনেক অনেক স্মৃতিকাতরতা আছে আমাদের।
আমার জন্য, আমার প্রিয়তম মায়ের জন্য আপনাদের কাছে দোয়া চাই প্রিয়বন্ধুগণ।
২২. ৬. ২৩
আমার মনে হয়—এটুকু বয়সের তুলনায় আমার এত এত দুঃখবোধ জড়ো হয়েছে; ফলত কারো সাথেই এই ভেঙে পড়া মনের কোনো সম্পর্ক নেই। পার্শ্ববর্তী দেশে এসেও প্রতিমুহূর্তে আমার মনে হয়—যদি আমি পাখি হতাম, যদি আমার দুটো ডানা থাকতো, তাহলে এক্ষুনি আমি মায়ের কাছে চলে যেতাম। কিন্তু মা’ও তো নেই—মা চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে আছে আমাকে একা রেখে। আমাকে একা রেখেই মা ঘুমিয়ে পড়েছে। মাগো—তোমার এত জলদি ঘুম পেয়ে যাবে আমি কখনো ভাবিনি, আমার ছোটোখাটো মস্তিষ্কের ভেতর আর কতটুকুই বা ভাববার শক্তি আছে!
আজ কতদিন! বাইশে জুন, আষাঢ়ে ঘনঘটা। আমি ফিরে আসতে চাই তোমার কাছে, তোমার সাথে কতকত গল্প বাকি—আড়ালের কত সত্য তোমাকে বলা হয়নি মা। তবু আশ্বস্ত হতে পারি এটা ভেবে যে, শেষবেলায় তোমাকে আমি একটা নিগূঢ় সত্য বলতে পেরেছি, তুমিও মেনে নিয়েছিলে—বলেছিলে, সুখী হও বাবা।
দেখো—আবারও আজ বৃহস্পতিবার। তোমার অসুস্থ দিনের কথা আমি লিখেছিলাম এমনই কোনো ‘কতিপয় বৃহস্পতির দিনলিপি’-তে। পরবর্তী কোনো বইয়ের পাতায় হয়তো তোমাকে নিয়ে আরও আরও স্মৃতিচারণ থাকবে, সেইসব দিনের কথা কীভাবে বলা হবে আমি জানি না। আমার হাত কাঁপছে মা, আমার বুক কাঁপছে, আমার চোখের পাতা ভিজে যাচ্ছে মা।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আমার চোখ ছলছল হয়ে থাকে। পরিজন ছেড়ে দূর দেশের ঘিঞ্জি গলির ভেতর একাকী থাকি, আমার বড়ো বিষণ্ণ লাগে। ঢাকা শহরের দূষিত হাওয়ায় বেড়ে ওঠা আমার জীবন—বুড়িগঙ্গার পাড় ঘিরে প্রতিদিনের আসা-যাওয়া যাপনই খুবখুব ভালো ছিল। তবু জীবনের বাঁক ঘোরে, আমাদের উচ্ছল সময়গুলো ফুরিয়ে যায়।
৩০. ৬. ২৩
একাকীত্বের যে বিষণ্ণ বলয়ে আমি বেড়ে উঠেছি—শহরের সবচেয়ে নিঃসঙ্গ সন্ধ্যার চোখও কেঁপে ওঠে এমন আবহে। সারাদিন বৃষ্টি, টিনের চালজুড়ে কীযে জনহীন স্তব্ধতা! কোনো কলরোল নেই কোথাও— জীবনের ফেসিনেশন হ্রাস হয়ে যায় ধীরে ধীরে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মতো বলার সাহস নেই। ‘এই মনোরম মনোটোনাস শহরে অনেক দিন পর আজ সুন্দর বৃষ্টি হলো’ প্রথমত মনোরম, তারপর মনোটোনাস! কী অদ্ভুত! একঘেয়ে বৈচিত্র্যহীনতা-কেও কী সুন্দরভাবে সমন্বিত করা যায়।
তবু এই একাকীত্বের যে করুণ গ্লানি আমরা বয়ে চলি—ফলত প্রায় দিনই আমাদের ঘরে ফিরতে দেরি হয়। কেননা, ঘরে ফিরলেই এক আকাশ শূন্যতা নেমে আসে—তারচেয়ে মোড়ের টঙ-দোকানে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডামুখর সময় কাটালে এইসব দুঃখ ভুলে থাকা যায়। তাই আমরা ঘরে ফিরতে চাই না। আমরা বহুদূর, উদ্দেশ্যহীন হেঁটে যেতে চাই শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে।
অনেক অনেক দিন আগে যখন বৃষ্টি হতো আমাদের গ্রামে—যখন আমার খুব ছোটোবেলা; তখন যেমন আনন্দ হতো, আজ এতগুলো বছর পর, মা আকাশের তারা হয়ে যাবার পর আমাদের জীবনের মোড় ঘুরে গিয়েছে আঁকাবাঁকা পথের সীমানায়। এখন আর বৃষ্টি ভালো লাগে না—শুধু বৃষ্টিই নয়। পৃথিবীর সকল ভালো লাগা মনের ভেতর থেকে উতরে উঠেছে।
আজ সন্ধ্যার পর মনে হলো—ঠিকঠাক লেখাজোঁকা হচ্ছে না। স্বস্তি তো নেই কোথাও, তবু যদি একটু একটু লিখতে পারার ফলে মনটা ঠিক হয়ে আসে...
১. ৭. ২৩
ষোলো সতেরো সালে মাদ্রাসাকেন্দ্রিক সাহিত্যের যে জোয়ার বইছিল তা হঠাৎ করেই, কোনো এক অজানা কারণে স্তব্ধ হয়ে যায়। তখন বিভিন্ন সাহিত্যগ্রুপ, সাহিত্য আড্ডার আয়োজন দেখা যেত সপ্তাহ সপ্তাহ। আমার দেখা সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিল বইপোকাদের আড্ডাখানা, চিঠিপত্র, লিখনসহ আরও অজস্র গ্রুপ। আমি নিজেও কয়েকটা গ্রুপের এডমিন/মডারেটর ছিলাম। এই জাগরণ ছিল খুবই উচ্ছ্বাসের, ছাত্ররাও নিয়মিত লিখত ফেসবুকে। সেসময়কার অনেক অনেক চেনামুখ কালের গহ্বরে তলিয়ে গেছে কেন যেন! আমার খুব মনে পড়ে সেইসব দিনগুলো—যদিও আমি কখনোই কোনো আড্ডায় যেতে পারিনি মুখচোরা স্বভাবের ফলে। তবে এভাবে সাহিত্যের সয়লাভ দেখে খুব আনন্দ হতো মনে।
বেয়ারিং করার সুবাদে বছরখানেক আগে মোহাম্মদপুরে একটা আড্ডার আসর করতাম আমরা, অনেকেই আসতো। আমার খুব ভালো লাগতো সেইসব আড্ডামুখর রাত্রিগুলোতে। কয়েকদিন ধরে নানান বিষয় মনের ভেতর খেলা করতো। শরীরের ভেতর অদ্ভুত এক আমেজ ছিল তখন, সেসব সময়ে।
কিন্তু, এমন দিন এখন—কোথাও দেখি না এমন আয়োজন। সাহিত্য আসরও সেভাবে চোখে পড়ে না আর। আমরা কী আমাদের জীবনের সুকোমল দিনগুলো ফেলে এসেছি এভাবেই! আমি আবারও খুব করে চাই, সপ্তাহ সপ্তাহ না হলেও অন্তত মাসে একবার হলেও যেন কেউকেউ সাহিত্যের আসর করেন। এতে নতুনরা সমৃদ্ধ হবে।
২. ৭. ২৩
দিল্লিতে যে আঠারো দিন আমি ছিলাম—মনে হয়েছিল জাহাজের ডেকে বসে অনন্তকাল ধরে ছুটে চলেছি সমুদ্রের পথে, কবে গন্তব্যে ফিরব, জানা নেই। প্রত্যেকটা দিন আমার অদ্ভুত যন্ত্রণায় কেটেছে। প্রতিদিনই মনে হয়েছে কবে শেষ হবে আমার কাজ—কবে ফিরব দেশে! মায়ের শেষবেলায় না থাকতে পারার তাড়না বয়ে বেড়াই আজও। প্রতি মুহূর্তে মনে হয়, মা অসুস্থ হবার আটটি মাস তার সাথে থাকতে পেরেছি—কিন্তু, বিদায়বেলায় কেন থাকতে পারলাম না! এখনও চারপাশে অধীর নীরবতা নেমে আসে।
মন হালকা রাখার জন্য বিকেল হলেই আমরা শহর থেকে দূরের কোনো রিসোর্টে চলে যেতাম—গলিঘুপচির ভেতর খুব নোংরা পরিবেশ হলেও দিল্লির পথগুলো এত ছায়াঘেরা, বৃক্ষের সারি সারি শামিয়ানা। মন শীতল হয়ে আসে।
খুব করে ভেবেছি—ভ্রমণকাহিনি লিখব, কিন্তু এ যাত্রার অভিজ্ঞতা মোটেও ভালো নয়। পরবর্তীতে যখন যাব, সেসময়ের দীর্ঘ যাপন নিয়ে ভ্রমণকাহিনি আমাকে লিখতেই হবে।
বয়স যত বাড়তে থাকে, ততই মনে হয়—যদি আমাদের জীবনটা শৈশবেই আটকে যেতো। আর যদি বড় না হতাম আমরা! তাহলে এই অদ্ভুত বিভীষিকাময় জীবনের পিছে পিছে দৌঁড়াতে হতো না আর।
৩. ৭. ২৩
আমার কোনো এক লেখায়—হয়তো কোনো এক গদ্যের শরীরের ভেতর লিখেছিলাম একটা নির্জন বেলকনি কীভাবে আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠেছিল। এখনও— আমার উদাস দিনগুলোতে সেই গ্রিলে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকি। আজও এলাম—কী চমৎকার হাওয়া। বেলকনির বাইরে যেসব গাছের ডালপালা এসে গ্রিলগুলো জড়িয়ে ধরেছে, তাদের কী উচ্ছ্বাস আমাকে দেখে! যেন বহুদিন পর দেখা প্রিয় কোনো বন্ধু। আমি তো ওদের বন্ধুই ভাবি। আমার সমস্ত দুঃখের কথা ওরা জানে। আজ জানাতে এসেছি আরও আরও মনোবেদনার কথা।
এটা আমার খালামণিদের বেলকনি—কী সুন্দর নির্জন। বন্ধুত্বের শূন্যতা, মায়ের শূন্যতা, আরও অনেক অনেক শূন্যতা নিয়ে এই নির্জনতার কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে থাকি আমি। খুব দুঃসাহসিক সময়ের প্লাবন এ!
আজ সকালে কিছু সময়ে রোদ উঠেছিল। কাদাটে রাস্তাগুলো শুকাতে শুরু করেছিল, এরই মাঝে আবারও ঝুম বৃষ্টি। কীযে আকাল দিন!
একজন লেখকের শুধুমাত্র শব্দ আর বাক্য ছাড়া আর কোনো হাতিয়ার নেই—তাই আমি ভাবি, কতভাবে, কতরূপে এইসব হাতিয়ার-কে আলুলায়িত করা যায়।
এত সুন্দর একটা চাঁদ উঠেছে আজ—দীর্ঘ এক মরুভূমির মতো মনে হয়, অথবা সমুদ্রের দিগন্ত থেকে উঁকি দেয়া অজস্র স্বপ্ন।
৫. ৭. ২৩
বিশ্বাস ভঙ্গ হতে হতে এমন এক পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে যে, নিজেকেও বিশ্বাস করতে ভুলে গিয়েছি। নিজের শরীর, হয়তো কোনো একটা অঙ্গও একদিন আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে। প্রতিবেশী মানুষের চোখে এত রক্ত, অন্ধকারের ভেতর থেকেও সেই রক্তের লাল ফুটে থাকে। তাই এই জনারণ্য হতে বিচ্ছিন্ন, কোনো শব্দহীন, নীল বন খুঁড়ে খুঁজে পাওয়া অমূল্য বাঙ্কারের ভেতর একা একা দীর্ঘ জীবন যাপন করতে চাই।
যা-কিছু হওয়া শুধুই সিনেমার মতো, তা-কিছুই আমরা ভাবি—মনে হয় এই তো আমার জীবনের কথা। গতকাল আবারও দেখলাম, চতুর্থবারের মতো, আমার প্রিয় সিনেমা ‘চার্লি’ ভবঘুরে জীবনের সোনালি পারদ।
ফেসবুক আমার কাছে লেখালেখির একটা ডায়েরির মতো। যখন যা ইচ্ছে হয়, ভাবনায় যখন যা উঁকি দেয়, এই ডায়েরিতে আমি টুকে রাখি, আমার লেখার পাঠকগণ তাদের অনুভূতি জানালে আমার খুব ভালো লাগে।
আজ খুব নদীর কাছাকাছি গিয়েছিলাম। কীযে অদ্ভুত সাদা-নীল আকাশের দিগন্ত। পেঁজা তুলো হয়ে উড়ছে যেন সাদা সাদা মেঘ নীল অভ্যুত্থানের মাঝে।
যত চাই মন ভালো হয়ে আসুক। ততই নিরানন্দ এসে ভর করে প্রতিদিনের আলপথে—জানি, একদিন সুসময় বয়ে যাবে চারপাশের আকাশে।
২৫. ৭. ২৩
একেবারে হঠাৎ করেই জীবনের মানচিত্র বদলে গেল। কত-কিছুই তো ভেবে রেখেছি, কত-কত স্বপ্নের বালুকণায় বুজে আসে চোখ। দু-তিন বছর আগেকার জীবন আর এখনকার এ জীবনের কোনো মিল খুঁজে পাই না৷ কেমন যেন বাঁধনছেঁড়া আর্তনাদ—এমন তো হবার কথা ছিল না, কখনো ভাবিনি এই সরলরেখার জীবনে দুর্বেদ কালো রাত নেমে আসবে। চতুর্পাশে দুর্দৈব প্রাচীর আর অনেক মুখোশপরা মানুষের সঙ্গে একসাথে অনিশ্চিত যাপনের দিনগুলো। সময় বড়ো অচেনা ঠেকছে আজকাল। কিছুই ভালো লাগে না—যেন পৃথিবীতে আমি একাই এক আদিম শূন্যতা।
Delhi Days
দিনলিপি | ১৫ জুন ২০২৩অ্যা জার্নি বাই ট্রেন—রাজধানী এক্সপ্রেসের সবটুকু অভিজ্ঞতাই আমি কোনো একদিন সেভাবেই লিখব। কলকাতার শিয়ালদহ স্টেশন থেকে দিল্লি পর্যন্ত প্রায় উনিশ ঘন্টার পথযাত্রায় কত কি দেখেছি, কত মানুষের সঙ্গে পরিচয়, এবং মায়ের মৃত্যুর খবর।
১৫. ৬. ২৩
আমার লিখতে পারার ক্ষমতা ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে কি না বুঝতে পারছি না—তবে আমি লিখতে না পারলে আমার কতিপয় শুভাকাঙ্ক্ষীরা যে দুঃখ পান, আমাকে তারা তা জানায়, তাতে আমারও খুব মন খারাপ হয়। কিন্তু এমন এক সময়ে এসে পৌঁছেছি আমি—আর কোনোদিন সেই অফুরন্ত সময় পাব কি না জানি না৷ সেই যে একা একা আমি বহুরাত অব্দি কোনো একটা গল্প লিখে শেষ করে ফেলতাম, কোনো বই ভালো লেগে গেলে শেষ না করে ঘুমোতে যেতাম না। সারাদিনই আমার অবসর সময় ছিল, কোনো ব্যস্ততা ছিল না, কোনো জঞ্জাল ছিল না চারপাশে। একা একা, অফুরান সময়-কে আলিঙ্গন করে সাহিত্যচর্চা করেছি, প্রতিদিনই নিয়ম করে লিখেছি কিছু না কিছু—সেই সময় হয়তো আমার ফুরিয়ে এসেছে। সেইসব সময় আমি ফেলে এসেছি।
আজ কয়েকদিন যাবৎ দিল্লিতে আছি। এখানকার পরিবেশ, সমাজ এবং সংস্কৃতির সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছি না। তবু আরও একমাস থাকতে হবে এখানে। কত যে কাজ—কত যে ব্যস্ততা।
মায়ের চলে যাওয়ার ভোরে আমি ছিলাম ট্রেনে, রাজধানী এক্সপ্রেসের স্লিপিং সিটে। শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ট্রেন ছেড়েছিল বিকেল চারটা পঞ্চাশে। যখন মায়ের খবর শুনি, তখন পরদিন ভোর পাঁচটা। দিল্লি তখনও বহুদূর—পাঁচঘন্টার পথ, মাঝে আর কোনো স্টেশন নেই। আমার মাথার উপর থেকে কী যেন সরে গেল হঠাৎ, বুকের ভেতর থেকে কী যেন ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল। আমি ভেঙে পড়লাম, চোখের পাতায় লেপ্টে ছিল অজস্র কান্না।
এইযে মায়ের সাথে আমার কতকত স্মৃতি—ভাবলেই আমার বুক ফেটে চৌচির হয়ে যায়। বাড়ি ফিরে কাকে ডাকব মা মা—আর কোনোদিনই মা আমাকে জিজ্ঞেস করবে না, বাবা! বাড়ি এলে কী খাবি বল, পিঠাপুলির দিন এলে কেউ আর জিজ্ঞেস করবে না, বাবা, তোর জন্য পাটিসাপটা বানাব কি না! এইযে এতসব স্মৃতি, মায়ের সাথে আমার চিরবন্ধুতা, এতকিছু একজীবনেও আমি লিখে শেষ করতে পারব না। তবু লিখতে পারছি না। অবশ্যই মা-কে নিয়ে আমি আমার সমস্ত গল্প বলব আপনাদের।
আজ মহান বৃহস্পতিবার—কী হয় এই বৃহস্পতিবারে! কিছুই না। তবু আমাদের অদ্ভুত এক ফ্যাসিনেশন কাজ করে। আমাদের মনে হয়, পৃথিবীর সবচেয়ে স্মৃতিকাতর দিন এ। অথচ এরচেয়েও অনেক অনেক স্মৃতিকাতরতা আছে আমাদের।
আমার জন্য, আমার প্রিয়তম মায়ের জন্য আপনাদের কাছে দোয়া চাই প্রিয়বন্ধুগণ।