আমার দিনলিপি
দিনলিপি | ২৯ নভেম্বর ২০২২
৭. ৮. ২২
ঘুম থেকে উঠতে খুব দেরি হয়ে গেল। রাতে ভালো ঘুম হয়নি, এমন সমস্যা অনেকদিন ধরেই চলছে। ফলত ফজর পড়ে আর হাঁটতে ইচ্ছে করে না। আজ যেতে হবে খিলগাঁও বাসাবো—গতকাল রাত থেকে বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় একবার ভাবলাম সাইকেল চালিয়েই চলে যাই, আবার মনে হল তীব্র রোদে সাইকেল চালাতে গিয়ে না জানি শরীরের বারোটা বেজে যায়। ঘুম থেকে উঠে ধীরেসুস্থে রিক্সা নিয়েই চলে গেলাম বেড়িবাঁধ মোড়ে, সেখান থেকে বাস না পেয়ে বাইকে চড়ে বসলাম আড়াইশ টাকায়।
বাসাবো থেকে যানজটের রাস্তা পেরিয়ে নন্দীপাড়া গিয়ে গলি-ঘুপচির দীর্ঘ জটে পড়ে গেলাম আবার। শেষে অনেকটা পথ হেঁটে গিয়ে অন্য আরেকটা অটোতে চড়ে দক্ষিণগাঁও ছয় নম্বর রোডের একতলা বাসার সামনে নেমে পড়লাম—এই আমার বড় ভাইয়ের শ্বশুরবাড়ি। কয়েকবছর পর আসা হল। এর মধ্যে অনেককিছু পাল্টে গেছে।
দুপুরের খাবারে এলাহী কাণ্ড। আমি এসেছি জন্য আমার মাউই হাঁস জবাই করেছেন, দুদিন আগে সুদূর কুমিল্লার হোমনা থেকে মাউইর বোন এসেছিল, সাথে এনেছিল বর্ষার পানিতে আটকে যাওয়া ডোবার পুটিমাছ। আমার পছন্দ জন্য উনি সেই পুটিমাছ ঝোল-ঝোল করে রান্না করলেন, গরুর মাংস, পুঁইশাক ভাজি করলেন। এত এত খাবার পরিবেশন করে বহুদিন পর কেউ আমাকে মুগ্ধ করল।
আসরের পূর্বেই রওনা হলাম—ফেরার সময় রাতের খাবার দিয়ে দিয়েছেন মাউই। বাসাবো এসে দেখি বাস নেই—আবার সেই বাইক, আড়াইশ টাকায় মোহাম্মদপুর।
কত কি অজানা বিস্ময়—তারপর নাগরিক ক্লান্তিতে এলোমেলো বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ি, আমার খুব ঘুম এসে যায়। সারাদিন শুয়ে-বসে, বই পড়ে আমার কোমর ব্যথা শুরু হয়েছে ক’দিন ধরে। সেজন্যই রাতে ঘুম আসে না।
৮. ৮. ২২
আজ তেমনকিছু করা হয়নি। পূর্ব দিনের মতোই আজ বই পড়েছি। ‘ট্রিপল সেভেন চার্লি দেখলাম’ ডিটেকটিভ ব্যোমকেশ বক্সি’ দেখা হল। রাকশিট শেঠির প্রথম কোনো সিনেমা দেখলাম, কিন্তু মনে হল বহুদিন ধরে চিনি একে, রিয়্যালিস্টিক অভিনয়, দারুণ—সাথের কুকুর চার্লির অভিনয় আরও মুগ্ধকর। মানুষ আর পশুর মমতা কেমন মায়াময় হতে পারে, তা এই সিনেমা না দেখলে কেউ বুঝতে পারবে না। IMDb তে 9/1 রেটিং।
বিকেলে আবুল হাসানের ‘অভাবিত’ গল্পটা পড়া হল—উত্তমপুরুষে খুব চমৎকার বর্ণনাভঙ্গিতে গল্প বলে গেছে প্রিয় কবি আবুল হাসান। কবিদের গদ্য বরাবরই চমৎকার। কিন্তু আবুল হাসান শামসুর রাহমানের মতে আপাদমস্তক কবিই ছিলেন। ফলত গল্পের রসদ তেমন জোরালো নয়।
এখন বসেছি সেদিনের অপারগ মুগ্ধতা নিয়ে—খুব বেশি মুগ্ধ হয়ে গেলে তা প্রকাশে খুব অপারগতা চলে আসে আমার। এই যেমন—কাজল চোখের শ্রাবণ।
৯. ৮. ২২
সকাল থেকেই আজ দারুণ হাওয়া বইছে। ফজর নামাজে উঠে আজ চমকে গিয়েছি এমন দখিনা বাতাসের তরঙ্গময় আবহে। মহররমের দশ তারিখ শোকাবহ দিন হলেও চারদিকে উৎসবের আমেজ আজ। বিশেষত শিয়াদের গাইগোত্র অপতৎপরতা খুবই বিরক্তিকর।
বিকেলে পরিচিত এক লোক এসে 330 Ml জমজম পানির বোতল, এক প্যাকেট খেজুর এবং একটা রুমাল উপহার দিয়ে গেল, হজ্ব থেকে আসার সময় আমার জন্য এই অসামান্য উপহার এনেছেন তিনি। কি চমৎকার! দিনের অন্যসব ক্লান্তি ভুলে গেলাম। নবি মুহাম্মাদ সাঃ এর পদচিহ্ন মুখরিত আরবের ধুলোকণা, আরবের হাওয়া লেগে আছে এই সমস্ত উপহারে। আমার মন ভালো হয়ে গেল।
কি অদ্ভুত আজকের চাঁদের আলো। অথচ আমি একাকী এই চাঁদের আলোয় হেঁটে যাই। তবু ভালো লাগে, কারো বদনাম শুনতে হয় না। কারো কাছে কৈফিয়ত দিতে হয় না। এই চির শান্তি, একাকী স্বাধীন জীবন।
সকাল থেকেই একটা গানের পঙ্ক্তি মাথার ভেতর ভ্রমরার মতো ঘুরছে। একটা না, কয়েকটা গানের কিছু পঙ্ক্তি। নাজাত আল সাগিরা/নাগাত আল সাগিরা’র ‘আনা বাশাক এল বাহার’। কি জাদুময় সুর, মিশরের আরেক কিংবদন্তি শিল্পী উম্মে কুলসুম। উম্মে কুলসুমের প্রতি আমার মুগ্ধতা কখনোই ফুরোবে না। এত মোহনীয় সুরের জাদুকর এরা—আমি মিশর গেলে অন্তত নাগিব মাহফুজ এবং উম্মে কুলসুমের গ্রাম থেকে ঘুরে আসব।
এন্তা উমরি... বলে যখন কুলসুম দীর্ঘ টান দেয়, তখন মনে হয় আমার হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। আমি চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিতে থাকি আর কুলসুমের প্রেমে পড়ে যাই। তাকে ভালোবেসে ফেলি।
আবারও শুনছি
I love the sea
Tender as you are
And at times, like you, crazy...
কিন্তু, খুব আবেগতাড়িত হয়ে পড়লাম যখন The black day of Egypt এর ছোট্ট একটা ক্লিপ দেখলাম। ১৯৭৪ সালের ৪ ই ফেব্রুয়ারি কিংবদন্তি উম্মে কুলসুম প্রয়াত হন। আর মিশরের জনসাধারণ নেমে পড়েন রাস্তায়। রাষ্ট্রীয় সম্মাননা দেয়া হয় তাকে। মানুষের হা-হুতাশ দেখেই মনে হল মিশরের মানুষের মধ্যমণি ছিল উম্মে কুলসুম। যার সুরের যাদুতে ভেসে গেছে আরববিশ্বের অগণিত মানুষ, তাদের মধ্যে আমিও এক হতভাগ্য, স্বপ্নের বিমূঢ়তায় ডুবে যাই।
১০. ৮. ২২
জোৎস্না গলা রাতে আমরা আজ একটা পাটি পেতে বসেছিলাম খোলা আকাশের নিচে—সবার গায়ে সাদা জুব্বা। চাঁদের আলোয় কতিপয় তরুণ দেখছে সাদা সাদা মেঘের পাহাড় উড়ে যাচ্ছে দূর কোথাও। আমরা বাদামের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে হেসে উঠি আর জীবনের এই অপূর্ব মুহূর্তের জন্য শুকরিয়া জানাই। যেরাতে চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়ে, সেরাতে আমাদের খুব ভালো লাগে এবং বদ্ধ রুমের দরোজা খুলে আমরা বাইরে বেরিয়ে পড়ি।
কিন্তু, মনের অবসাদ জেঁকে বসে আবারও। তখন এইসব আবহ ম্লান হয়ে যায়।
১১. ৮. ২২
আগস্টের দিনগুলো আমাকে খুবই বিপর্যস্ত করে তোলে। যত দিন বদল হচ্ছে ততই ট্রমাটিক স্মৃতিগুলো মূর্তিকার রূপে ভেসে উঠছে চারপাশের রঙিন দেয়ালে। আমার আর ভালো লাগে না। এমন এক বেদনা মনের ভেতর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে—যা কল্পনারও অতীত। যা ভাবনারও অসীম এবং হারিয়ে ফেলার অসহিষ্ণু ক্রন্দন।
আজ শ্রাবণী পূর্ণিমা রাত—সমুদ্রপারে বসে আমার এই পূর্ণিমা দেখতে খুব ইচ্ছে করছে অথবা মাঝ নদীতে একটা নৌকায় বসে পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দের সাথে যদি মিশে যেতাম আজ এই অপূর্ব তিথির আলোয়...
১২. ৮. ২২
ঢাকা শহরের শুক্রবার সন্ধ্যা খুবই সুন্দর। ততটা কোলাহলবিমুখ না হলেও কেমন যেন ঝিমধরা অলস অলস পথ। যানজট আছে, তদর্থ বিবচেনায় তবু তা অন্যদিনের ঝঞ্জাটের চেয়ে লঘু মনে হয়।
আজ এসেছি বাতিঘর—সাথে দুই স্বপ্নবাজ তরুণ। মুয়াজ ও মোবারক। ওদের চোখজুড়ে থৈথৈ স্বপ্নেরা খেলা করে, ওদের ভাবনাজুড়ে শুধু শিল্পিত অনুরণন।
সিকদার আমিনুল হকের ‘সতত ডানার মানুষ’ আর দু’টো অনবদ্য নোটবুক কিনে ফিরে এলাম কাঁটাবন মোড়ে। আজ বহুদিন পর উদরপূর্তি হয়েছে মোড়ের ভেলপুরি আর পানিপুরি খেয়ে।
এই এখন এত রাতে আমরা বসে আছি আল্লাহকরিম মসজিদের সিঁড়িতে। কাঠবাদাম গাছের পাতার ফাঁক গলে দূরের আল মানার হাসপাতাল।
মোহাম্মদপুর—স্মৃতির আলেখ্যে মনোনীত এক অদ্ভুত প্রতিমা।
১৫. ৮. ২২
জীবনের এই বিচিত্র কলোরোল আর শোক দিবসে আরও আরও শোকাবহ সংবাদ। চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডে ঘুমন্ত ছয়জনের মৃত্যু, উত্তরায় ফ্লাইওভারের গার্ডার পড়ে প্রাইভেটকারে পাঁচ যাত্রীর মৃত্যু। কোথাও বাসের গতি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে অসংখ্য যাত্রী আহত।
চারপাশের এই অজস্র মৃত্যু সংবাদে আরও কুঁকড়ে যাই। মনের যত অবসাদ তা কান্না হয়ে ঝরে পড়ে। এমন একটা দিন নেই, যেদিন আমরা কোনো দুঃসংবাদ না শুনে ঘুমোতে পেরেছি। শোকদিবস ফিরে আসে, তবু মানুষের শোকের দিন ফুরোবে কি না তা কেউ বলতে পারে না। আমাদের জিহ্বা থেকে রক্ত ছলকে গেছে—আমরা কথা বলতে পারি না। স্বৈরাচারের শোষণ আর কতদিন—আমরা জানি না। আমরা ঘরের কোণে বসে বসে আর্টফিল্ম দেখি।
মনে হয় এই প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের প্রতিক্রিয়া মানুষের মন-মননে দারুণভাবে কষাঘাত করছে। এইসব প্রযুক্তির ব্যবহার হতাশাগ্রস্ত জীবনের দিকেই টেনে নিচ্ছে আমাদের।
যার মনের কান্না, যার হারিয়ে ফেলার দুঃখ কেবল সেই উপলব্ধি করতে জানে। আর কেউ না। পাশের মানুষের এমন দুঃসময় দেখতেও আর ভালো লাগে না। রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনা, সমাজের নৈতিক অবক্ষয় কিভাবে জনমানুষের প্রতিদিনকার জীবনে অস্বস্তি বয়ে আনছে, তা দেখতে পাচ্ছেন?
সবকিছু সয়ে যেতে হবে, সবকিছুর হিসেব হবে একদিন।
১৯. ৮. ২২
কয়েকদিন কিছুই লেখা হয়নি। বিশেষত দিনলিপির পাণ্ডুলিপি গুছিয়ে ফেলার পর প্রতিদিনকার টুকরো ভাবনাগুলো টুকে রাখতে পারছি না অলসতাজনিত কারণে। শুধুই অলসতা নয়—নানাবিধ জটিলতাও তার কারণ। গতকাল সবগুলো বইপত্র শেল্ফ থেকে নামিয়ে ঝাড়পোছা করে শেল্ফদু’টো ঘুরিয়ে অন্যদিকের দেয়ালের সাথে ঠেকিয়ে দিয়েছি, চৌকিটা ঘুরালাম জানলা বরাবর, যেন জানলার গ্লাসের বাইরে সবুজ মাধবীলতাগুলো ঠিকভাবে চোখে পড়ে। হলও তাই—রাতে ঘুমিয়ে খুব আরাম পেয়েছি—গরমে কয়েকবার ঘুম ভেঙে যায় রাতে, ঠিক তখনই জানলা খুলে দিলে নরম বাতাস বয়ে যায়।
আজ জুমার পর মুয়াজ-কে নিয়ে গেলাম ছোট্ট একটা ঘরোয়া হোটেলে, দুপুরের খাবার খেতে। এখানে মাটির চুলোয় কয়েকরকম তরিতরকারি রান্না করা হয়। প্রায় শোনা যায়, মাটির চুলোর রান্না গ্যাসের চুলোর তুলনায় সুস্বাদু হয়। সেজন্য আরও আগ্রহ নিয়ে এখানে খেতে আসি কয়েকদিন যাবৎ। একদিন বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে আবিষ্কার করেছিলাম একটা চা দোকানের সাথে লাগোয়া খুপরির মতো জায়গায় কয়েকটা টেবিল বসিয়ে ভাত বিক্রি করা হয়। গুড়োমাছ বেগুন আর আলুর সংমিশ্রণে খুব সুস্বাদু উপায়ে রান্না করে এরা।
সন্ধ্যার পর আসলাম একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে। আল মদিনা কমিউনিটি সেন্টার। কেন যেন এইসব ভিড়ভাট্টা, জনসমাগম আমার ভালো লাগে না। তবু একা থাকার কার্যত উপায় জানা থাকলে পৃথিবীর যেকোনো জায়গায়, যেকোনো মহাসমাবেশও খুব একা থাকা যায়।
রাত এগারোটা বাজে—আমি মাঝ নদীতে। নৌকা পার হয়ে যাচ্ছি খোলামোড়া। কতদিন পর এখানে এলাম। কামরাঙ্গীচরের অলিগলিতে হেঁটেছি বহুদিন। রহিম মামা যতদিন বেঁচে ছিল, প্রায় সময় আমি চলে আসতাম মামার কাছে। উনি মারা যাবার পর আর আসা হয়নি। আজ এসে ভালো লাগছে যদিও—নদীজলের তরঙ্গে ভেসে যাচ্ছে আমার মন, দূরের আলোকিত শহর।
২১. ৮. ২২
আমার যা-কিছু তড়িঘড়ি করেই হয়ে যায়। যেমন আজ সন্ধ্যায় হঠাৎ বেরিয়ে পড়লাম কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে। কোথায় যাব জানি না। চট্টগ্রাম, ফরিদপুর, সাতক্ষীরা না বরিশাল! শেষে থিতু হলাম চট্টগ্রামই যাব। এর মাঝে আমার সহযাত্রী জুটে গেল পাঁচজন। ভেবেছিলাম একা একাই ভ্রমণে বেরুই—তা আর হল না। আমার সহযাত্রী সকলের হাতের মুঠোয় আর চোখে-মুখে শিল্পিত ছায়া খেলা করে। সেজন্য আমরা কমলাপুর থেকে উঠে বসলাম চিটাগং মেইলে। লোকাল ট্রেন, একশ পনেরো টাকার ভাড়ায় কত দূরের পথ। কিন্তু সমস্যা হল হুল্লোড় করেই উঠতে হয় এই ট্রেনে, আমি তা পারি না। আমার সহযাত্রী তাশরিফ ভাই কেমন করে যেন এই সমস্ত তড়িত্ প্রবাহের কাজগুলো করে ফেলেন—গফরগাঁওয়ের চতুর লোক তাশরিফ আহমাদ।
প্রায় পাঁচবছর পর যাচ্ছি চট্টগ্রাম—দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় দারুল ইন’আম থেকে পালিয়ে গিয়েছিলাম হাটহাজারী মাদ্রাসায়। কি অদ্ভুত, তারপর গিয়েছিলাম বন্ধুদের সাথে ভ্রমণে। এখন যাচ্ছি আবারও... এই শহর, এই পাহাড় সমুদ্রের কলতান—আমার ভালো লাগে।
২২. ৮. ২২
আজ বেশ কয়েক জায়গায় ভ্রমণ হল আমাদের। প্রথমত সকালে নেমেছি সীতাকুণ্ড স্টেশনে, সেখান থেকে সীতাকুণ্ড পাহাড়ে উঠে এবারের মতো জীবন নিয়ে ফিরে এসেছি। কখনো এমন বিশাল পাহাড়ে উঠিনি—শহরের দালানে শুয়ে-বসে দিন পার করলে তো এমন হাপিত্যেশ হবারই কথা। অনেক কষ্টে যখন একেবারে পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে পেরেছি—তখন পুরো চট্টগ্রাম শহরের বিশাল ভবনগুলো-কে মনে হচ্ছিল পাখির বাসা, দীর্ঘ ট্রেনের ছুটে চলা পথগুলোকে মনে হচ্ছিল সংখ্যাহীন পায়ের ছোট্টো পোকার মতো।
তারপর আমরা এ-কে খান রোডে মায়ামী হোটেলে রুম নিই আগামীকাল বিকেল পর্যন্ত। সারারাতের ক্লান্তি আর পাহাড় জয়ের অবসাদ নিয়ে হোটেল রুমে প্রবেশ করেই গোসল সেরে বিছানায় গা এলিয়ে দিই। এ-সি রুমের শীতল আবহে আমাদের ঘুম ভাঙে প্রায় আসর হয় যখন।
পতেঙ্গা সী-বিচে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে যায়—তবু সমুদ্রের মায়াবী তরঙ্গে মন ভালো হয়ে গেল সবার। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই উপভোগ্য—সেজন্য সুযোগ কখনোই হাতছাড়া করতে চাই না আমি। তাই বেলুন ফাটানো থেকে শুরু করে স্পিড-বোটে চড়ে বেড়ানো, ফটোগ্রাফারের ক্যামেরায় বন্দি হওয়া, ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতেও সমুদ্রের পারে বসে থেকেছি বহুরাত পর্যন্ত।
২৩. ৮. ২২
আজ গিয়েছিলাম চট্টগ্রাম সি-আর-বি, শতবছরের বৃক্ষ। ছায়াঘন নিরিবিলি পরিবেশ খুুব ভালো লেগেছে। তারপর বাতিঘর। ঢাকার বাতিঘরের চেয়ে চট্টগ্রাম বাতিঘর বেশ পুষ্ট মনে হল। কিছুক্ষণ থেকে আমরা চলে গেলাম মোমিন রোডের ডি-সি হিল সংলগ্ন প্রিয় চন্দ্রবিন্দুর অফিসে। এ আরেক স্বর্গ—দু’তলার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই অনবদ্য দেয়াল পেইন্টিং, ফাঁকে শৈল্পিক বুননে কিছু কবিতার পঙক্তি। প্রকাশক চৌধুরী ফাহাদ, শিল্পী আল নোমান আমাদের সাদরে গ্রহণ করল—ফাহাদ ভাইয়ের আন্তরিকতা আমাদের আনন্দ দিয়েছে। আমার বই ‘মেহেরুন, প্রিয়তম ফুল’ যেন চেয়ে আছে আমার দিকে—তাকে তাকে প্রিয় সব লেখকদের বই।
সন্ধ্যার আগে আগে বেরুলাম চন্দ্রবিন্দুর অফিস থেকে—পাশেই নজরুল স্কোয়ারে রাত ন’টা পর্যন্ত আড্ডা শেষে স্টেশনের উদ্দেশে যাব—কিন্তু সাজিদ আসছে সেই আগ্রাবাদ থেকে, জ্যামে আটকে আছে—ওর জন্য অপেক্ষা করলাম তবু। দেখে মনে হল বাচ্চা, তবু ওর আত্মবিশ্বাস আমাকে আপ্লুত করে, বহুদূর এগিয়ে যাবে সাজিদ।
চট্টগ্রামে এসে আমার সবচেয়ে বিরক্তি লেগেছে এখানকার হোটেলওয়ালাদের উপর। ঢাকায় আমরা যেটাকে সবজি বলি, পরোটার সাথে যা পরিবেশন করা হয়, এখানে নাকি অতিরিক্তি ঝোল, আর কাঁকরোল দিয়েই রান্না করা হয় এই সবজি—আমরা কোনোবেলাই ভালোমতো খেতে পারিনি। এ মহা বিরক্তিকর!
আমার সহযাত্রী ছিল তাশরিফ আহমাদ, এফাজ মোবারক, নাজমুস সাকিব, মাহমুদ এবং মুয়াজ আব্দুল্লাহ। এরা খুব ভালো। বিশেষত আমার প্রতি ওদের শ্রদ্ধা আমাকে বেশ সাহস যুগিয়েছ।
আমরা দু’জন রাত দশটার বাস আর ওরা তিনজন ট্রেনে চড়ে বসেছে। আমাদের যাত্রা শেষ হল।
২৪. ৮. ২২
আজ সকালে আসাদ গেইটে নেমেছি। সকালের নির্ঝঞ্জাট ঢাকা অন্যরকম, চোখের আরাম। মোহাম্মদপুরের মাঝে এই আসাদ গেইট থেকে আল্লাহ করিমের দিকে যে রাস্তাটা চলে গেছে, টাউন হলের আগ পর্যন্ত। সেন্ট জোসেফ স্কুলের এরিয়াটুকু আর ইকবাল রোডের গলি-ঘুপচিগুলো আমার খুব ভালো লাগে।
বাড়ি এসে সময় কাটাবার মতো কিছু নেই—মানিপ্লান্টের পাতাগুলো অনেক বড় হয়েছে, এমন বিশালাকার পাতা কখনো দেখিনি এর৷ মেহগনির ডালপালা জড়িয়ে ধরেছে। আর বাগানবিলাসও বেড়ে উঠছে, স্ন্যাক-প্লান্ট আর মায়ের লাগানো পুঁইশাকের পাতা ঝরে পড়া দৃশ্যের ভেতরই আমার যা ব্যস্ততা।
ইলেক্ট্রিসিটির এমন আকাল চলছে—দিনে কয়েকবার ইলেক্ট্রিসিটির আসা-যাওয়া খুব বিরক্তিকর—তবু শহরের চেয়ে গ্রাম ভালো। অন্তত ঘরের ভেতরে ফ্যানের বাতাস না পেলেও জানালা খুলে দিলেই হুহু হাওয়া বয়ে যায়। উঠোনে পিঁড়ি পেতে বসলেই শরীর হিম হয়ে আসে।
৩০. ৮. ২২
আজ নাগিব মাহফুজের মৃত্যুদিন। দুই হাজার ছয় সালের ত্রিশে আগস্ট পরলোক গমন করেন সাহিত্যে নোবেলবিজয়ী প্রথম আরব্য ঔপন্যাসিক নাগিব মাহফুজ। লাভ ইন দ্য রেইন, আল কারনাক, তাহতাল মিযাল্লার মতো উপন্যাস রচিত হয়েছে যার জাদুকরী কলমের ছোঁয়ায়। যে ‘চিলড্রেন অব গেবেলোই’ এর জন্য আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন আরবী সাহিত্যের এই রাজকুমার। আজ তার মৃত্যুদিন। উনিশশো আটাশি সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি।
মিশরীয় সমাজ-বাস্তবতা আগের মতো আর নেই। বিশেষত মিশরীয় নাগরিক সভ্যতা কবেকার কোন প্রলয়ের পর থেকে ধূলিসাৎ হয়ে গেছে, বলতে পারি না। তবু অর্থনৈতিক উৎপীড়ন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, মানুষের প্রগলভতা থেকেই বোঝা যায় মিশরের জনজীবন কতটা বিধ্বস্ত হতে চলেছে।
যেমন দু-দিন পরপরই তুচ্ছ কোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে মানুষের সম্মুখেই কুপিয়ে হত্যা করা, প্রেমিকাকে ছুরিকাঘাত করে নিজেই আবার সেই ছুরি দিয়ে আত্মাহুতি—হবু স্ত্রী পরীক্ষায় ফেল হবে জেনে পুরো স্কুলে আগুন ধরিয়ে দেয়ার মতো কত কত ঘটনা যে ঘটছে প্রিয় মিশরে! ভাবলেই কেমন লাগে! নিজের ভাটি দেশেও তো কম নয়! পৃথিবীর কোথাও শান্তি নেই। মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার মানুষই খুইয়ে ফেলছে।
মৎস্য ভবন পেরিয়ে বাস ছুটে চলে। আমি জানলার পাশেই বসেছি, তবু রোদের কুণ্ডলী শরীরের সাথে লেপ্টে আছে আর অবিরাম ঘাম ঝরছে। গ্রীষ্মের চেয়ে শীতের দুপুর আমার ভালো লাগে।
ফেরার সময় আসরের নামাজ পড়া হল বাইতুল মোকাররমে। পুরোনো অভ্যাসের মতো আমার কমদামি ফোন দিয়ে কয়েকটা ছবি তুললাম ভিন্ন-ভিন্ন আঙ্গিকে। বাস্তবে যা দেখা যায়, ছবিতে তারচেয়ে নান্দনিক দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা যায়। শিল্পীর মাহাত্ম্য এখানেই। যদিও ফটোগ্রাফি তেমন আত্মস্থ হয়নি—তাই বলে আগ্রহটা কম নেই একেবারে। কোনো একটা কবিতা বা গদ্য লিখে ফেলার পর যেমন অদ্ভুত আনন্দ অনুভূত হয়—সুন্দর একটা ছবি তোলা হলে তেমনই ভালো লাগে।
ফেরার সময় আল্লাহকরিম নেমে গেলাম আরও কিছু ছবি তোলার জন্য—কিন্তু ততক্ষণে সূর্য ডুবে গিয়েছে, শুধু পশ্চিমাকাশে লাল আভাটুকু রেখার মতো ফুটে আছে। তবু নূরজাহান রোডের সেই ছায়াঘেরা কলোনিতে গিয়ে আলো-আঁধারির সন্ধ্যায় কয়েকটা ছবি তুলতে পেরেছি—তেমন ভালো হয়নি, রোদের আলো ছাড়া এখনকার ছবি ভালো আসবে না বলে সুপার মার্কেটের মোড় থেকে ঢাকা উদ্যানের রিক্সায় উঠে বসলাম। পৌঁছাতে পৌঁছাতে মাগরিব হয়ে এল।
তবু নাগিব মাহফুজের মৃত্যুদিনে কেমন যেন দায়বদ্ধ অঙ্গিকারের মতো তাকে মনে পড়ছে। ওপারে ভালো থেকো প্রিয় ঔপন্যাসিক, কায়রোর গলিতে বেড়ে ওঠা আশ্চর্য জাদুকর।
৩১. ৮. ২২
নদীরপারে কয়েকদিন আগে ডি-জুস ক্যাফে খোলা হয়েছে—দোকানের পরিসর ছোটো, তবু সাদামাটা ইন্টেরিয়র ডিজাইন দূর থেকে চোখে ভাসে। আজ কি মনে করে সন্ধ্যার পর ডি-জুসে গেলাম তাদের সবচে হাই রেটেড খাবারের স্বাদ নেয়ার জন্য। লেমন মোহিত, মালাই চা এবং বিফ মাসালা মুড়ি নিয়েছি। দামের তুলনায় শুধু লেমন মোহিতটাই একটু বেশি মনে হয়েছে, তাছাড়া তাদের অন্যান্য খাবারের দাম যথার্থ মনে হল। ওয়েটার বিহেভিয়ারও মন্দ নয়।
ফেরার সময় পরিচিত রিক্সা নিয়ে আমার খানকায় ফিরলাম—আমাকে নামিয়ে দিয়েই দরদি কণ্ঠে সে বলতে লাগল; আমি আর বাবার সাথে থাকি না এখন। আমি বাবা হতে যাচ্ছি আগামী মাসে, আমার জন্য দোয়া কইরেন ভাই। তার নাম মেহেদি, তার চোখে চোখ পড়তেই কেমন যেন থমকে গেলাম। সে কাঁদছে। তার বাবা তাকে বিনাদোষেই বাড়ি থেকে বিতাড়িত করেছে, তাই বউ নিয়ে আলাদা বাসায় থাকে। জীবিকানির্বাহের জন্য এই অটো-রিক্সাই তার সম্বল। মেহেদির সাথে আমার পরিচয় ঘটে বছর দুয়েক আগে যখন আমি নিয়মিত পত্রিকা রাখতাম, সে বাড়িতে বাড়িতে পত্রিকা পৌঁছে দেয়ার কাজ করত। তার বাবার পেশাও এটাই। অবশ্য মেহেদি আজই আমাকে বলল, তার এই বাবা মূলত তার সৎ বাবা। সেজন্যই তাকে আপন সন্তানের মতো কাছে টানতে পারেনি। মেহেদি-কে বললাম অন্যকোনোদিন আমার বাসায় যেন আসে। আমি তার সমস্ত দুঃখের কথা শুনব।
এমন এক সময়ে আমরা উপনীত হয়েছি—যেখানে শুধু হতাশা, বিষণ্নতা এবং কলহের বাইরে কেউ নেই।
২. ৯. ২২
আজ আমরা বেরিয়েছিলাম ছাগল অভিযানে—আটিবাজারে হাঁট বসে শনিবার এবং মঙ্গলবার। কিন্তু শুক্রবার ছাগল কিনতে এসে পড়লাম মহা বিপদে। এক চাওয়ালা বলল, আজকেই কিনতে চাইলে আমাদের যেতে হবে জিঞ্জিরা হাঁটে। কিন্তু মোহাম্মদপুরের পাশেই যে গাবতলী বা টাউনহল বাজারে শুক্রবারে ছাগল পাওয়া যায়, তা জেনেছি মোহাম্মদপুর ফিরে আসার পর। তবু জিঞ্জিরা হাঁটে গিয়ে নতুন অভিজ্ঞতা হল আজ। গ্রাম না হলেও গ্রামীণ আবহের মতো এই হাঁট, নদীর পারে বটতলা—তার মধ্য দিয়েই বয়ে গেছে বিশাল বাজার। আজ শুধু হাঁটের দিন।
ছাগল কেনার বাজেট আহামরি না হলেও মোটামুটি বাজেটের মধ্যে ছাগল কিনব আমরা—দরদাম শুরু হল, শেষমেশ আট হাজার টাকায় কিনতে পেরেছি।
প্রাতঃভ্রমণ বহুদিন পর—কেরাণীগঞ্জ তরতরিয়ে উন্নত হচ্ছে। পথগুলো পিচঢালা, সারি সারি সবুজ বৃক্ষের হাতছানি আর তার দীর্ঘ ছায়া। সরসরে পাতার দুলুনি। গতকাল খুবই বিমর্ষ কেটেছে, আজ খুব ভালো লাগছে বাইরে বেরিয়ে। শুক্রবারের প্রসন্ন হাওয়ায় আমার মন ভালো হয়ে গেল।
৩. ৪. ২২
আলবার্ট হিউজের The Book of Eli দেখার পর কয়েকদিন শুধু সেই সিনেমার চিত্রগুলো ভেসেছে চারপাশে। যদি সত্যিই পৃথিবী এমন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে যায় এবং খাদ্যের অভাব দেখা দেয়, তখন মানুষের কি পরিণতি হবে! হয়তো এই সিনেমার মতো মানুষ পশুর চেয়ে নিকৃষ্ট হয়ে যাবে তখন। একজন আরেকজন-কে হত্যা করে খেয়ে ফেলতে চাইবে, এবং প্রতিজন মানুষই অপর মানুষের দিকে অবিশ্বাস আর সংশয়ের চোখে তাকাবে। পানি নেই, খাদ্য নেই, আলো নেই, ধূ ধূ বিধ্বস্ত পৃথিবীর বুকে শস্য ফলানোর মতো জায়গাও নেই। কি হবে তখন! বেঁচে থাকার জন্য শুধু অপর মানুষ-কে খুন করে তার মাংস খেয়ে উদরপূর্তি করার অপেক্ষা।
পৃথিবী কি এই সিনেমার পটভূমির মতোই হতে পারে অদূর ভবিষ্যতে! সমস্ত দ্বিধা নিয়ে, অস্থিরতার মতো যন্ত্রণা নিয়ে এমন রাতে রণজিৎ দাশের কবিতা মনে পড়ে:
‘প্রাণ মূলত এক গোপন সুগন্ধ, যা আজীবন শরীরের ভিতর বাসা বেঁধে থাকে, এবং মৃত্যুর মুহূর্তে শরীরকে ছেড়ে চলে যায়’।
তবু পৃথিবীর এমন দুঃসময়ে একটু ভালো থাকাটাই মূখ্য। বেঁচে থাকা না থাকার অধিকার মানুষের নেই। ইচ্ছা-অনিচ্ছার মানদণ্ডে অগণিত মানুষের ভাষ্য একটাই— বেঁচে থাকতে ভালো লাগে না। খুব বিষণ্ণতা, বুকের ভেতর পাথর চাপা আর্তনাদ।
৮. ৯. ২২
বইয়ের শেষ দিনলিপিতে কি লিখব ভেবে পাচ্ছি না। এখানেই শেষ নয়, তবু সময়ের প্রয়োজনে ইতি টানতে হচ্ছে। বহুদিন পর নিশ্চয়ই নতুন কোনো দিনলিপির সংকলনে আমাকে খুঁজে পাবেন প্রিয় পাঠক। শেষ দিনলিপি বলতে আমার স্বভাবজাত লেখার মতোই কিছু একটা লিখতে হচ্ছে।
আটই সেপ্টেম্বরের পাশাপাশি আজ বৃহস্পতিবার। একদিন অন্তত কিছু লিখতে না পারলে ভেতরের অস্থিরতা আরও ফেঁপে ওঠে। যেন কবিতা ছাড়া এটুকু দিনের আলো আর কেউ দিতে পারে না। ঘুম ভেঙে যায়—তবু কবিতার শব্দ মস্তিস্কে অনুরণন তোলে, আর ঘুম আসে না। আমার প্রেম কেবল কবিতার সাথে। যার ভাবনা আমাকে ঘুমোতে দেয় না, যার শরীরে কেবল নানানরকম উদ্ভাস।
বৃহস্পতিবার এলে নিজেকে খুব গুটিয়ে রাখতে ইচ্ছে হয়, প্রিয়তম ভুলের মতো যেন হারিয়ে ফেলেছি যা-কিছু রক্ষিত ছিল রোজনামচার পাতায়।
কিছুই করা হল না—সারাদিন মেহেরুন-কে ভেবেছি আর ব্যর্থ প্রেমিকের মতো কাঁদতে দেখেছি একজন তরুণকে। ব্যর্থ প্রেম বলে কিছু নেই—প্রেম চিরকাল স্বর্গীয় আনন্দের উৎস। আমরা শুধুমাত্র মায়ার জন্য ছেড়ে আসতে পারি না—নয়তো সমস্ত মায়ার বন্ধন ছিঁড়ে কোথায় যে চলে যেতাম...
আমার কেন কোনো ভালো বন্ধু নেই—সেই রহস্য আজও খুঁজে পাইনি। অনেকেই আসে বন্ধু হয়ে, প্রেমিকা হয়ে—কিন্তু পুনরাবৃত্তির মতো আচমকা যদি ফিরে আসে আমার পুরোনো প্রেমিকা—তাহলে আরও বহুদিন বেঁচে থাকার আকুলতা নিয়ে তোমাকে বলা হত—ফুল ফুটো না, সুবাস ফুরিয়ে যাবে।
আরও পড়ুন
৯, শান্তি পার্ক, কলকাতা ৭০০০৯৪
দিনলিপি | ২০ ডিসেম্বর ২০২৩হসপিটালের পাশেই শান্তি পার্ক কলোনি। এত ছিমছাম সুন্দর গোছানো গলি-তে নাগালের ভেতর রুমভাড়া পেয়ে যাব ভাবিনি। মার্কুইস স্ট্রিটের কালিন কলোনির নোংরা পরিবেশ আর আকাশছোঁয়া হোটেল ভাড়া আমাকে খুবই বিব্রত করে তুলেছিল। সারাদিন ঘুরে-ফিরে অবশেষে এমন এক কলোনিতে এসে পৌঁছেছি, যেখানের রাতগুলো হলুদ আলোয় মোড়ানো—প্রতিটা গলিতে পুরোনো দিনের পাকদণ্ডী মাকড়সার দেয়াল।
তিনদিন হলো এখানে। লেখালেখির সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটেছে যেন—নতুন কিছু লেখা হচ্ছে না। মাথার ভেতর অকথ্য যন্ত্রণা হয় যখন অনেককিছু লিখতে চাই কিন্তু শব্দেরা অযথা দূরে সরে যেতে থাকে।
২.
কখনো কোথাও একই একটা বারান্দা—আমরা চেয়ে আছি নির্বাক আরেকটা বারান্দার দিকে। প্রতিরাতের ঠিক নির্দিষ্ট সময়ে তারা বারান্দায় আসে, তাদের রুমে আলো জ্বলে, একদম ভোরবেলা আবার তারা বেরিয়ে পড়ে। আমরা কোথাও বেরুই না। আমাদের এক আকাশ অবকাশ—তবু আমাদের বাইরের আবহ ভালো লাগে না, অনেক মানুষের সমাগম ভালো লাগে না। এইটুকু, এই একটু ছোট্ট বারান্দায় আমরা লাগিয়েছি একটা মানিপ্লান্ট, আরেকটা ছোট্ট পাত্রে লাগিয়েছি একজোড়া রেইন লিলি।
৩.
আজ আর কিছু নয়। আমরা আমাদের জীবনটাকে এমনভাবে গুছিয়ে নিতে চেয়েছি, যেন কারো সঙ্গে সংঘাত-বিরোধের সৃষ্টি না হয়। কেউ যেন আমাদের দ্বারা মনোকষ্ট না পায়—এবং আমরাও ঠিক ভেবে রেখেছি যেন কেউ আমাদের আঘাত করতে না পারে। জানি এভাবে বেঁচে থাকা সহজ নয়, যতটা সহজ মানুষের পাশে বসে-বসে, চোখে চোখ রেখে মিথ্যে বলা। কতদিন কত শূন্য পথ ফেলে কেউ চলে গিয়েছিল এভাবে। আর কোনোদিন তাকে পাওয়া যায়নি। কখনো ফিরে আসবে কি না কেউ জানে না—তাই এত সংযত জীবনের কথা। খুব বৃষ্টি হলেই কেবল মেঘভাঙা উতল শ্রোত বয়ে যায় এইসব পুরোনো গলিগুলোতে।
৪.
সারাদিন এক অদ্ভুত আমেজ নিয়ে হেঁটেছি আজ। কলেজস্ট্রিটে পুরোনো বইয়ের সন্ধ্যানে, বুদ্ধদেব গুহ’র ‘সবিনয় নিবেদন’, অনুপম রায়ের তিনটে বইসহ আরও বেশ কয়েকটি বই কেনা হলো৷ একটু আগেই ফিরে এলাম বাসায়। তারা এখনো ফেরেনি, হয়তো আরেকটু রাত হলে, আরেকটু অন্ধকার গাঢ় হলে চুপিচুপি আজ তারা ঘরে ফিরবে৷ আমি তাদের প্রতিদিন, একই একটি বারান্দা থেকে দেখতে পাই।
আমার একাকী রাত্রির বিষন্ন দিনলিপি
দিনলিপি | ১ সেপ্টেম্বর ২০২৩৬. ৬. ২৩
মা যে আর নেই—আমি ভাবতেই পারছি না। আমার ভাবতে কষ্ট হচ্ছে—মনে হচ্ছে মা একটু পরই আমাকে কল করে জিজ্ঞেস করবে দুপুরে খেয়েছি কি না, ঠিকঠাক গন্তব্যে পৌঁছেছি কি না—আটটি মাস মা কেমন ধীরে ধীরে ফুরিয়ে যাচ্ছিল, আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি মায়ের শরীরে ভেতর কীভাবে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছে। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে মা—তুমি যে দূর আকাশের তারা হয়ে গিয়েছ, আমাদের বুক চৌচির হয়ে যাচ্ছে। তোমার হাতে রান্না করা আমার প্রিয় টমেটোর চাশনি আর কোনোদিনই খেতে পারব না মা।
মাগো—ও মা! জান্নাতের সবুজ উদ্যানে তুমি আনন্দে থেকো। আল্লাহপাক তোমাকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম দান করুক।
১৫. ৬. ২৩
আমার লিখতে পারার ক্ষমতা ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে কি না বুঝতে পারছি না—তবে আমি লিখতে না পারলে আমার কতিপয় শুভাকাঙ্ক্ষীরা যে দুঃখ পান, আমাকে তারা তা জানায়, তাতে আমারও খুব মন খারাপ হয়। কিন্তু এমন এক সময়ে এসে পৌঁছেছি আমি—আর কোনোদিন সেই অফুরন্ত সময় পাব কি না জানি না৷ সেই যে একা একা আমি বহুরাত অব্দি কোনো একটা গল্প লিখে শেষ করে ফেলতাম, কোনো বই ভালো লেগে গেলে শেষ না করে ঘুমোতে যেতাম না। সারাদিনই আমার অবসর সময় ছিল, কোনো ব্যস্ততা ছিল না, কোনো জঞ্জাল ছিল না চারপাশে। একা একা, অফুরান সময়-কে আলিঙ্গন করে সাহিত্যচর্চা করেছি, প্রতিদিনই নিয়ম করে লিখেছি কিছু না কিছু—সেই সময় হয়তো আমার ফুরিয়ে এসেছে। সেইসব সময় আমি ফেলে এসেছি।
আজ কয়েকদিন যাবৎ দিল্লিতে আছি। এখানকার পরিবেশ, সমাজ এবং সংস্কৃতির সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছি না। তবু আরও একমাস থাকতে হবে এখানে। কত যে কাজ—কত যে ব্যস্ততা।
মায়ের চলে যাওয়ার ভোরে আমি ছিলাম ট্রেনে, রাজধানী এক্সপ্রেসের স্লিপিং সিটে। শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ট্রেন ছেড়েছিল বিকেল চারটা পঞ্চাশে। যখন মায়ের খবর শুনি, তখন পরদিন ভোর পাঁচটা। দিল্লি তখনও বহুদূর—পাঁচঘন্টার পথ, মাঝে আর কোনো স্টেশন নেই। আমার মাথার উপর থেকে কী যেন সরে গেল হঠাৎ, বুকের ভেতর থেকে কী যেন ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল। আমি ভেঙে পড়লাম, চোখের পাতায় লেপ্টে ছিল অজস্র কান্না।
এইযে মায়ের সাথে আমার কতকত স্মৃতি—ভাবলেই আমার বুক ফেটে চৌচির হয়ে যায়। বাড়ি ফিরে কাকে ডাকব মা মা—আর কোনোদিনই মা আমাকে জিজ্ঞেস করবে না, বাবা! বাড়ি এলে কী খাবি বল, পিঠাপুলির দিন এলে কেউ আর জিজ্ঞেস করবে না, বাবা, তোর জন্য পাটিসাপটা বানাব কি না! এইযে এতসব স্মৃতি, মায়ের সাথে আমার চিরবন্ধুতা, এতকিছু একজীবনেও আমি লিখে শেষ করতে পারব না। তবু লিখতে পারছি না। অবশ্যই মা-কে নিয়ে আমি আমার সমস্ত গল্প বলব আপনাদের।
আজ মহান বৃহস্পতিবার—কী হয় এই বৃহস্পতিবারে! কিছুই না। তবু আমাদের অদ্ভুত এক ফ্যাসিনেশন কাজ করে। আমাদের মনে হয়, পৃথিবীর সবচেয়ে স্মৃতিকাতর দিন এ। অথচ এরচেয়েও অনেক অনেক স্মৃতিকাতরতা আছে আমাদের।
আমার জন্য, আমার প্রিয়তম মায়ের জন্য আপনাদের কাছে দোয়া চাই প্রিয়বন্ধুগণ।
২২. ৬. ২৩
আমার মনে হয়—এটুকু বয়সের তুলনায় আমার এত এত দুঃখবোধ জড়ো হয়েছে; ফলত কারো সাথেই এই ভেঙে পড়া মনের কোনো সম্পর্ক নেই। পার্শ্ববর্তী দেশে এসেও প্রতিমুহূর্তে আমার মনে হয়—যদি আমি পাখি হতাম, যদি আমার দুটো ডানা থাকতো, তাহলে এক্ষুনি আমি মায়ের কাছে চলে যেতাম। কিন্তু মা’ও তো নেই—মা চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে আছে আমাকে একা রেখে। আমাকে একা রেখেই মা ঘুমিয়ে পড়েছে। মাগো—তোমার এত জলদি ঘুম পেয়ে যাবে আমি কখনো ভাবিনি, আমার ছোটোখাটো মস্তিষ্কের ভেতর আর কতটুকুই বা ভাববার শক্তি আছে!
আজ কতদিন! বাইশে জুন, আষাঢ়ে ঘনঘটা। আমি ফিরে আসতে চাই তোমার কাছে, তোমার সাথে কতকত গল্প বাকি—আড়ালের কত সত্য তোমাকে বলা হয়নি মা। তবু আশ্বস্ত হতে পারি এটা ভেবে যে, শেষবেলায় তোমাকে আমি একটা নিগূঢ় সত্য বলতে পেরেছি, তুমিও মেনে নিয়েছিলে—বলেছিলে, সুখী হও বাবা।
দেখো—আবারও আজ বৃহস্পতিবার। তোমার অসুস্থ দিনের কথা আমি লিখেছিলাম এমনই কোনো ‘কতিপয় বৃহস্পতির দিনলিপি’-তে। পরবর্তী কোনো বইয়ের পাতায় হয়তো তোমাকে নিয়ে আরও আরও স্মৃতিচারণ থাকবে, সেইসব দিনের কথা কীভাবে বলা হবে আমি জানি না। আমার হাত কাঁপছে মা, আমার বুক কাঁপছে, আমার চোখের পাতা ভিজে যাচ্ছে মা।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আমার চোখ ছলছল হয়ে থাকে। পরিজন ছেড়ে দূর দেশের ঘিঞ্জি গলির ভেতর একাকী থাকি, আমার বড়ো বিষণ্ণ লাগে। ঢাকা শহরের দূষিত হাওয়ায় বেড়ে ওঠা আমার জীবন—বুড়িগঙ্গার পাড় ঘিরে প্রতিদিনের আসা-যাওয়া যাপনই খুবখুব ভালো ছিল। তবু জীবনের বাঁক ঘোরে, আমাদের উচ্ছল সময়গুলো ফুরিয়ে যায়।
৩০. ৬. ২৩
একাকীত্বের যে বিষণ্ণ বলয়ে আমি বেড়ে উঠেছি—শহরের সবচেয়ে নিঃসঙ্গ সন্ধ্যার চোখও কেঁপে ওঠে এমন আবহে। সারাদিন বৃষ্টি, টিনের চালজুড়ে কীযে জনহীন স্তব্ধতা! কোনো কলরোল নেই কোথাও— জীবনের ফেসিনেশন হ্রাস হয়ে যায় ধীরে ধীরে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মতো বলার সাহস নেই। ‘এই মনোরম মনোটোনাস শহরে অনেক দিন পর আজ সুন্দর বৃষ্টি হলো’ প্রথমত মনোরম, তারপর মনোটোনাস! কী অদ্ভুত! একঘেয়ে বৈচিত্র্যহীনতা-কেও কী সুন্দরভাবে সমন্বিত করা যায়।
তবু এই একাকীত্বের যে করুণ গ্লানি আমরা বয়ে চলি—ফলত প্রায় দিনই আমাদের ঘরে ফিরতে দেরি হয়। কেননা, ঘরে ফিরলেই এক আকাশ শূন্যতা নেমে আসে—তারচেয়ে মোড়ের টঙ-দোকানে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডামুখর সময় কাটালে এইসব দুঃখ ভুলে থাকা যায়। তাই আমরা ঘরে ফিরতে চাই না। আমরা বহুদূর, উদ্দেশ্যহীন হেঁটে যেতে চাই শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে।
অনেক অনেক দিন আগে যখন বৃষ্টি হতো আমাদের গ্রামে—যখন আমার খুব ছোটোবেলা; তখন যেমন আনন্দ হতো, আজ এতগুলো বছর পর, মা আকাশের তারা হয়ে যাবার পর আমাদের জীবনের মোড় ঘুরে গিয়েছে আঁকাবাঁকা পথের সীমানায়। এখন আর বৃষ্টি ভালো লাগে না—শুধু বৃষ্টিই নয়। পৃথিবীর সকল ভালো লাগা মনের ভেতর থেকে উতরে উঠেছে।
আজ সন্ধ্যার পর মনে হলো—ঠিকঠাক লেখাজোঁকা হচ্ছে না। স্বস্তি তো নেই কোথাও, তবু যদি একটু একটু লিখতে পারার ফলে মনটা ঠিক হয়ে আসে...
১. ৭. ২৩
ষোলো সতেরো সালে মাদ্রাসাকেন্দ্রিক সাহিত্যের যে জোয়ার বইছিল তা হঠাৎ করেই, কোনো এক অজানা কারণে স্তব্ধ হয়ে যায়। তখন বিভিন্ন সাহিত্যগ্রুপ, সাহিত্য আড্ডার আয়োজন দেখা যেত সপ্তাহ সপ্তাহ। আমার দেখা সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিল বইপোকাদের আড্ডাখানা, চিঠিপত্র, লিখনসহ আরও অজস্র গ্রুপ। আমি নিজেও কয়েকটা গ্রুপের এডমিন/মডারেটর ছিলাম। এই জাগরণ ছিল খুবই উচ্ছ্বাসের, ছাত্ররাও নিয়মিত লিখত ফেসবুকে। সেসময়কার অনেক অনেক চেনামুখ কালের গহ্বরে তলিয়ে গেছে কেন যেন! আমার খুব মনে পড়ে সেইসব দিনগুলো—যদিও আমি কখনোই কোনো আড্ডায় যেতে পারিনি মুখচোরা স্বভাবের ফলে। তবে এভাবে সাহিত্যের সয়লাভ দেখে খুব আনন্দ হতো মনে।
বেয়ারিং করার সুবাদে বছরখানেক আগে মোহাম্মদপুরে একটা আড্ডার আসর করতাম আমরা, অনেকেই আসতো। আমার খুব ভালো লাগতো সেইসব আড্ডামুখর রাত্রিগুলোতে। কয়েকদিন ধরে নানান বিষয় মনের ভেতর খেলা করতো। শরীরের ভেতর অদ্ভুত এক আমেজ ছিল তখন, সেসব সময়ে।
কিন্তু, এমন দিন এখন—কোথাও দেখি না এমন আয়োজন। সাহিত্য আসরও সেভাবে চোখে পড়ে না আর। আমরা কী আমাদের জীবনের সুকোমল দিনগুলো ফেলে এসেছি এভাবেই! আমি আবারও খুব করে চাই, সপ্তাহ সপ্তাহ না হলেও অন্তত মাসে একবার হলেও যেন কেউকেউ সাহিত্যের আসর করেন। এতে নতুনরা সমৃদ্ধ হবে।
২. ৭. ২৩
দিল্লিতে যে আঠারো দিন আমি ছিলাম—মনে হয়েছিল জাহাজের ডেকে বসে অনন্তকাল ধরে ছুটে চলেছি সমুদ্রের পথে, কবে গন্তব্যে ফিরব, জানা নেই। প্রত্যেকটা দিন আমার অদ্ভুত যন্ত্রণায় কেটেছে। প্রতিদিনই মনে হয়েছে কবে শেষ হবে আমার কাজ—কবে ফিরব দেশে! মায়ের শেষবেলায় না থাকতে পারার তাড়না বয়ে বেড়াই আজও। প্রতি মুহূর্তে মনে হয়, মা অসুস্থ হবার আটটি মাস তার সাথে থাকতে পেরেছি—কিন্তু, বিদায়বেলায় কেন থাকতে পারলাম না! এখনও চারপাশে অধীর নীরবতা নেমে আসে।
মন হালকা রাখার জন্য বিকেল হলেই আমরা শহর থেকে দূরের কোনো রিসোর্টে চলে যেতাম—গলিঘুপচির ভেতর খুব নোংরা পরিবেশ হলেও দিল্লির পথগুলো এত ছায়াঘেরা, বৃক্ষের সারি সারি শামিয়ানা। মন শীতল হয়ে আসে।
খুব করে ভেবেছি—ভ্রমণকাহিনি লিখব, কিন্তু এ যাত্রার অভিজ্ঞতা মোটেও ভালো নয়। পরবর্তীতে যখন যাব, সেসময়ের দীর্ঘ যাপন নিয়ে ভ্রমণকাহিনি আমাকে লিখতেই হবে।
বয়স যত বাড়তে থাকে, ততই মনে হয়—যদি আমাদের জীবনটা শৈশবেই আটকে যেতো। আর যদি বড় না হতাম আমরা! তাহলে এই অদ্ভুত বিভীষিকাময় জীবনের পিছে পিছে দৌঁড়াতে হতো না আর।
৩. ৭. ২৩
আমার কোনো এক লেখায়—হয়তো কোনো এক গদ্যের শরীরের ভেতর লিখেছিলাম একটা নির্জন বেলকনি কীভাবে আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠেছিল। এখনও— আমার উদাস দিনগুলোতে সেই গ্রিলে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকি। আজও এলাম—কী চমৎকার হাওয়া। বেলকনির বাইরে যেসব গাছের ডালপালা এসে গ্রিলগুলো জড়িয়ে ধরেছে, তাদের কী উচ্ছ্বাস আমাকে দেখে! যেন বহুদিন পর দেখা প্রিয় কোনো বন্ধু। আমি তো ওদের বন্ধুই ভাবি। আমার সমস্ত দুঃখের কথা ওরা জানে। আজ জানাতে এসেছি আরও আরও মনোবেদনার কথা।
এটা আমার খালামণিদের বেলকনি—কী সুন্দর নির্জন। বন্ধুত্বের শূন্যতা, মায়ের শূন্যতা, আরও অনেক অনেক শূন্যতা নিয়ে এই নির্জনতার কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে থাকি আমি। খুব দুঃসাহসিক সময়ের প্লাবন এ!
আজ সকালে কিছু সময়ে রোদ উঠেছিল। কাদাটে রাস্তাগুলো শুকাতে শুরু করেছিল, এরই মাঝে আবারও ঝুম বৃষ্টি। কীযে আকাল দিন!
একজন লেখকের শুধুমাত্র শব্দ আর বাক্য ছাড়া আর কোনো হাতিয়ার নেই—তাই আমি ভাবি, কতভাবে, কতরূপে এইসব হাতিয়ার-কে আলুলায়িত করা যায়।
এত সুন্দর একটা চাঁদ উঠেছে আজ—দীর্ঘ এক মরুভূমির মতো মনে হয়, অথবা সমুদ্রের দিগন্ত থেকে উঁকি দেয়া অজস্র স্বপ্ন।
৫. ৭. ২৩
বিশ্বাস ভঙ্গ হতে হতে এমন এক পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে যে, নিজেকেও বিশ্বাস করতে ভুলে গিয়েছি। নিজের শরীর, হয়তো কোনো একটা অঙ্গও একদিন আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে। প্রতিবেশী মানুষের চোখে এত রক্ত, অন্ধকারের ভেতর থেকেও সেই রক্তের লাল ফুটে থাকে। তাই এই জনারণ্য হতে বিচ্ছিন্ন, কোনো শব্দহীন, নীল বন খুঁড়ে খুঁজে পাওয়া অমূল্য বাঙ্কারের ভেতর একা একা দীর্ঘ জীবন যাপন করতে চাই।
যা-কিছু হওয়া শুধুই সিনেমার মতো, তা-কিছুই আমরা ভাবি—মনে হয় এই তো আমার জীবনের কথা। গতকাল আবারও দেখলাম, চতুর্থবারের মতো, আমার প্রিয় সিনেমা ‘চার্লি’ ভবঘুরে জীবনের সোনালি পারদ।
ফেসবুক আমার কাছে লেখালেখির একটা ডায়েরির মতো। যখন যা ইচ্ছে হয়, ভাবনায় যখন যা উঁকি দেয়, এই ডায়েরিতে আমি টুকে রাখি, আমার লেখার পাঠকগণ তাদের অনুভূতি জানালে আমার খুব ভালো লাগে।
আজ খুব নদীর কাছাকাছি গিয়েছিলাম। কীযে অদ্ভুত সাদা-নীল আকাশের দিগন্ত। পেঁজা তুলো হয়ে উড়ছে যেন সাদা সাদা মেঘ নীল অভ্যুত্থানের মাঝে।
যত চাই মন ভালো হয়ে আসুক। ততই নিরানন্দ এসে ভর করে প্রতিদিনের আলপথে—জানি, একদিন সুসময় বয়ে যাবে চারপাশের আকাশে।
২৫. ৭. ২৩
একেবারে হঠাৎ করেই জীবনের মানচিত্র বদলে গেল। কত-কিছুই তো ভেবে রেখেছি, কত-কত স্বপ্নের বালুকণায় বুজে আসে চোখ। দু-তিন বছর আগেকার জীবন আর এখনকার এ জীবনের কোনো মিল খুঁজে পাই না৷ কেমন যেন বাঁধনছেঁড়া আর্তনাদ—এমন তো হবার কথা ছিল না, কখনো ভাবিনি এই সরলরেখার জীবনে দুর্বেদ কালো রাত নেমে আসবে। চতুর্পাশে দুর্দৈব প্রাচীর আর অনেক মুখোশপরা মানুষের সঙ্গে একসাথে অনিশ্চিত যাপনের দিনগুলো। সময় বড়ো অচেনা ঠেকছে আজকাল। কিছুই ভালো লাগে না—যেন পৃথিবীতে আমি একাই এক আদিম শূন্যতা।
Delhi Days
দিনলিপি | ১৫ জুন ২০২৩অ্যা জার্নি বাই ট্রেন—রাজধানী এক্সপ্রেসের সবটুকু অভিজ্ঞতাই আমি কোনো একদিন সেভাবেই লিখব। কলকাতার শিয়ালদহ স্টেশন থেকে দিল্লি পর্যন্ত প্রায় উনিশ ঘন্টার পথযাত্রায় কত কি দেখেছি, কত মানুষের সঙ্গে পরিচয়, এবং মায়ের মৃত্যুর খবর।
১৫. ৬. ২৩
আমার লিখতে পারার ক্ষমতা ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে কি না বুঝতে পারছি না—তবে আমি লিখতে না পারলে আমার কতিপয় শুভাকাঙ্ক্ষীরা যে দুঃখ পান, আমাকে তারা তা জানায়, তাতে আমারও খুব মন খারাপ হয়। কিন্তু এমন এক সময়ে এসে পৌঁছেছি আমি—আর কোনোদিন সেই অফুরন্ত সময় পাব কি না জানি না৷ সেই যে একা একা আমি বহুরাত অব্দি কোনো একটা গল্প লিখে শেষ করে ফেলতাম, কোনো বই ভালো লেগে গেলে শেষ না করে ঘুমোতে যেতাম না। সারাদিনই আমার অবসর সময় ছিল, কোনো ব্যস্ততা ছিল না, কোনো জঞ্জাল ছিল না চারপাশে। একা একা, অফুরান সময়-কে আলিঙ্গন করে সাহিত্যচর্চা করেছি, প্রতিদিনই নিয়ম করে লিখেছি কিছু না কিছু—সেই সময় হয়তো আমার ফুরিয়ে এসেছে। সেইসব সময় আমি ফেলে এসেছি।
আজ কয়েকদিন যাবৎ দিল্লিতে আছি। এখানকার পরিবেশ, সমাজ এবং সংস্কৃতির সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছি না। তবু আরও একমাস থাকতে হবে এখানে। কত যে কাজ—কত যে ব্যস্ততা।
মায়ের চলে যাওয়ার ভোরে আমি ছিলাম ট্রেনে, রাজধানী এক্সপ্রেসের স্লিপিং সিটে। শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ট্রেন ছেড়েছিল বিকেল চারটা পঞ্চাশে। যখন মায়ের খবর শুনি, তখন পরদিন ভোর পাঁচটা। দিল্লি তখনও বহুদূর—পাঁচঘন্টার পথ, মাঝে আর কোনো স্টেশন নেই। আমার মাথার উপর থেকে কী যেন সরে গেল হঠাৎ, বুকের ভেতর থেকে কী যেন ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল। আমি ভেঙে পড়লাম, চোখের পাতায় লেপ্টে ছিল অজস্র কান্না।
এইযে মায়ের সাথে আমার কতকত স্মৃতি—ভাবলেই আমার বুক ফেটে চৌচির হয়ে যায়। বাড়ি ফিরে কাকে ডাকব মা মা—আর কোনোদিনই মা আমাকে জিজ্ঞেস করবে না, বাবা! বাড়ি এলে কী খাবি বল, পিঠাপুলির দিন এলে কেউ আর জিজ্ঞেস করবে না, বাবা, তোর জন্য পাটিসাপটা বানাব কি না! এইযে এতসব স্মৃতি, মায়ের সাথে আমার চিরবন্ধুতা, এতকিছু একজীবনেও আমি লিখে শেষ করতে পারব না। তবু লিখতে পারছি না। অবশ্যই মা-কে নিয়ে আমি আমার সমস্ত গল্প বলব আপনাদের।
আজ মহান বৃহস্পতিবার—কী হয় এই বৃহস্পতিবারে! কিছুই না। তবু আমাদের অদ্ভুত এক ফ্যাসিনেশন কাজ করে। আমাদের মনে হয়, পৃথিবীর সবচেয়ে স্মৃতিকাতর দিন এ। অথচ এরচেয়েও অনেক অনেক স্মৃতিকাতরতা আছে আমাদের।
আমার জন্য, আমার প্রিয়তম মায়ের জন্য আপনাদের কাছে দোয়া চাই প্রিয়বন্ধুগণ।